পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর কারিগরি সহযোগিতা ও অর্থায়নে এবং পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) কর্তৃক বাস্তবায়িত সমন্বিত কৃষি ইউনিট (কৃষি খাত) এর আওতায় চরফ্যাশন উপজেলার কাশেমগঞ্জ গ্রামে ট্রাইকো কম্পোস্ট প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ও লিচেট ব্যবহারে কৃষকদের মধ্যে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে। এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত সার ও লিচেট ব্যবহারে উপকৃত হচ্ছেন কৃষকেরা। ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ব্যবহারে মাটির গঠন ও বুনট উন্নত করে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, পানির অপচয় রোধ করে। এ সার মাটির অম্লত্ব ও লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ করে ফসলের উৎপাদন ও গুণগত মান বাড়িয়ে কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
এছাড়া ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদনের সময় যে লিচেট (তরলজাতীয়) সংগ্রহ করা হয়, তা বিভিন্ন সবজি ও পানের বরজে ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ফসলের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে করা যায়। তাই স্বল্প খরচে ও সহজ পদ্ধতিতে উৎপাদিত এ সার ও লিচেট ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ট্রাইকো কম্পোস্ট থেকে উৎপাদিত সার জমিতে ব্যবহার করে ভালো ফলন পেয়েছেন কৃষকেরা। ইতিমধ্যে চরফ্যাশন উপজেলার কাশেমগঞ্জ এলাকার আশেপাশের বেশ কয়েকজন কৃষক এ প্রযুক্তি দেখে সার উৎপাদন ও ব্যবহার করছেন। তাঁরা ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদনের সময় যে লিচেট সংগ্রহ করা হয়, তা পানের বরজ ও বিভিন্ন সবজি চাষে ব্যবহার করে ভালো ফলন পাচ্ছেন। এতে উপজেলার অন্য কৃষকের মধ্যেও এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত সার ও লিচেট ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে।
টিন বা খড়ের চালাসহ একটি ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট পাকা চৌবাচ্চা অথবা স্যানিটারি রিং দ্বারা বানানো হাউসে ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরি করতে হয়। এতে গোবর ২৮ শতাংশ, মুরগির বিষ্ঠা ৩৬ শতাংশ, সবজির উচ্ছিষ্ট ৫ শতাংশ, কচুরিপানা ২৫ শতাংশ, কাঠের গুঁড়া ৩ শতাংশ, নিমপাতা ১ শতাংশ ও চিটাগুড় ২ শতাংশ এই অনুপাতে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এক টন মিশ্রণ পচাতে ৫০০ মিলি ট্রাইকো ড্রামা অণুজীব মেশাতে হয়। এতে ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে জৈব পদার্থ পচে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদিত হয় ও লিচেট পাওয়া যায়।
চরফ্যাশন উপজেলার কাশেমগঞ্জ গ্রামের কৃষক সোলেয়মান বলেন, পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) কৃষি কর্মকর্তা এর পরামর্শে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন। তাঁর দুটি চেম্বার থেকে প্রথমবার ৫০ লিটার লিচেট সংগৃহীত হয়। এটা জমিতে ব্যবহার করে তিনি ভালো ফলন পেয়েছেন। ফলন ভালো হওয়ায় অন্য কৃষকেরাও তাঁর কাছ থেকে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ও লিচেট কিনে নিয়ে তাঁদের জমিতে ব্যবহার করছেন।
পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) এর কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, ট্রাইকো কম্পোস্ট হলো এক ধরনের জৈব সার, যার মূল উপাদান ট্রাইকোডার্মা নামক একধরনের উপকারী ছত্রাক। বিভিন্ন জৈব উপাদান, যেমন গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, সবজির উচ্ছিষ্ট, কচুরিপানা, কাঠের গুঁড়া, ভুট্টার ব্রান, চিটাগুড়, ছাই ও নিমপাতা এবং ট্রাইকোডারমা ছত্রাকের অণুবীজ নির্দিষ্ট অনুপাতে একত্রে মিশিয়ে তা বিশেষ উপায়ে হাউসে জাগ দিয়ে ৪০-৪৫ দিন রেখে পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কম্পোস্ট তৈরি করা হয়, তাই ট্রাইকো কম্পোস্ট আর কম্পোস্ট সার তৈরির সময় হাউস থেকে নির্গত তরল নির্যাসকে ট্রাইকো লিচেট বলে।
চরফ্যাশন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান বলেন, ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদনে কৃষক দুইভাবে লাভবান হচ্ছেন। প্রথমত, এ সার জমিতে ব্যবহার করে কৃষকেরা ভালো ফলন পাচ্ছেন। অপরদিকে ট্রাইকো লিচেট ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগবালাই দমনে তা ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কৃষকদের রোগবালাই দমনে কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, ট্রাইকো কম্পোস্ট থেকে উৎপাদিত সার ও লিচেট ব্যবহার করে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। অন্য কৃষকদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে। তাই ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদন ও লিচেট ব্যবহারে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
কোকোডাস্ট পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে সাফল্য
বীজ তলায় চারা উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দেখা যায়, ৫০-৬০% চারা গজায়, আবার সে চারা ক্ষেতে রোপন করলে অনেক চারা মারা যায়। কৃষকের এ ধরনের সমস্যা বিবেচনা করে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় এবং স্থানীয় সংস্থা পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) এর সমন্বিত কৃষি ইউনিটের মাধ্যমে কোকোডাস্টের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন সবজির চারা উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
সবজি চাষের জন্য পরিচিত ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলা। রাস্তার দুই পাশে সবুজে ঢাকা বিভিন্ন ধরনের মন মাতানো সবজির ক্ষেত দেখা যায়। সারা বছরেই এ অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সবজি যেমন ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, করলা, লাউ, বেগুন, শসা, টমেটো ইত্যাদির চাষ হয়ে থাকে। সবজি চাষের জন্য কৃষকরা বীজ তলায় সবজির চারা উৎপাদন করে থাকে।
পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) এ বছর ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষন ইউনিয়নে জুয়েল সিকদার নামে একজনকে কোকোডাস্টের মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে। জুয়েল সিকদার এ বছর প্লাস্টিকের মাধ্যমে প্রায় এক পঞ্চাশ হাজার বিভিন্ন ধরনের চারা উৎপন্ন করেন এবং তিনি চারা বিক্রয় করেন। সরেজমিনে দেখা যায়, তার নার্সারীতে হতে বহু কৃষক চারা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন।
জুয়েল সিকদার বলেন, কোকোডাস্টের মাধ্যমে উৎপন্ন চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বলে জমিতে রোপন করার পর কোন চারা মারা যায় না। আবার এ চারায় রোগজীবাণুর আক্রমণ কম হয় এবং গাছ দ্রুত সুস্থ সবল হয়ে বাড়তে থাকে। এ চারা রোপন করলে ১৫-২০ দিন আগে ফসল সংগ্রহ করা যায়। তিনি এ মাসে প্রায় ৫০ হাজার শসা, মরিচ, ধুন্দুল, করলা, চিচিঙ্গার চারা উৎপাদন করেছেন। কৃষকরা তার নার্সারী হতে চারা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আশা করছেন, চারা বিশ দিনের মধ্য বিক্রি হয়ে যাবে। এতে তিনি লাভবান হবেন বলে আশা করছেন।
উন্নত মানের চারা উৎপাদনের জন্য সার্বক্ষনিক কারিগরি পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) এর কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো: মনিরুল ইসলাম তিনি বলেন, কোকোডাস্টের মাধ্যমে চারা উৎপাদন একটি আধুনিক পদ্ধতি। মাটির স্পর্শ ছাড়া চারা উৎপন্ন করা হয় বলে মাটি বাহিত রোগ জীবানু হয় না। মাটির বদলে কোকোডাস্ট দেওয়া হয়। কোকোডাস্ট হলো নারিকেল ছোবার গুড়া। নারিকেলের গুড়ায় যে লবন থাকে সেটি প্রথম অপসারণ করা হয়। এ গুড়া প্লাস্টিকের ট্রেতে দিয়ে চারা বসিয়ে দেওয়া হয়। চারার পুষ্টি চাহিদা পূরনের জন্য স্প্রের মাধ্যমে খাদ্যর যোগান দেওয়া হয়। পোকামাকড় যাতে এ চারায় আক্রমন করতে না পারে তাই চারার চারদিকে মশারীর নেট দেওয়া হয়। আবার প্রখর রোদের তাপ হতে রক্ষার জন্য চারার উপড়ে শেডনেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। কঠোর নিয়ন্ত্রণনের মাধ্যমে চারা উৎপন্ন করা হয় বলে এ চারা অনেক সুস্থ ও সবল হয়ে।
তিনি আরো বলেন, কৃষককে ভালো মানের চারা উৎপন্ন করার জন্য পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) সব সময় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
মালচিং পেপার পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে কৃষক অধিক লাভবান
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় এবং স্থানীয় সংস্থা পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) এই মালচিং পেপার পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করছে। অধিক পরিমাণে লাভজনক হওয়ায় দিন দিন মালচিং পেপার পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। চরফ্যাশন উপজেলার কৃষকদের মাঝে পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) এই মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষে সফলতা এনে দিয়েছে। সবসময় কৃষকের পাশে থেকে কাজ করছে এ সংস্থা। এক কৃষকের সফলতায় আগ্রহী হচ্ছেন অন্য কৃষকরা। জমির মাঝে দুই পাশ থেকে কেটে দেড় ফুট চওড়া করে ও ৮-১২ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে বেড তৈরি করা হয়। তৈরি বেডগুলো মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।মালচিং পেপারের কালো রঙের দিকটা থাকে নিচে আর সিলভার রঙের দিকটা থাকে উপরের দিকে অর্থাৎ সূর্যের দিকে। সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে মাটিকে রাখে ফসলের জন্য উপযোগী। পরে মালচিং পেপারের দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গোল গোল করে কেটে নেওয়া হয়। আর এরপর কেটে নেওয়া জায়গায় রোপণ করা হয় সবজি বীজ বা চারা। উপজেলায় মালচিং পেপার পদ্ধতিতে জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ হচ্ছে। সরকারিভাবে এই পদ্ধতিটি কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হলে, তা দ্রুত গ্রহণ করবে কৃষক। আর খাদ্যঘাটতি পূরণ করে চাহিদা সহজেই পূরণ করতে পারবেন কৃষকরা।