এনামূল হক পলাশ: নায়েব ফারসি শব্দ, যার অর্থ প্রতিনিধি। কোনো কর্মকর্তা যিনি অন্য কোনো কর্মকর্তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ করেন, অথবা যিনি কারও অনুপস্থিতিতে বা পরিবর্তে কাজ করার জন্য নিয়োজিত হন, তিনিই নায়েব। মুগল আমলের শেষদিকে কোনো অনুপস্থিত কর্মকর্তার স্থলে দায়িত্ব পালন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নায়েব বলা হতো। মুগল প্রশাসনের অধীনে সুবাহদারগণও কখনো কখনো নায়েবের দায়িত্ব পালন করতেন। কোনো নাবালক যুবরাজ সুবাহদার হিসেবে মনোনীত হলে, সে ক্ষেত্রে একজন নায়েব তার স্থলে সুবাহদারের দায়িত্ব পালন করতেন এবং যুবরাজ শিক্ষানবিশের পর্যায়ে থাকতেন। মুগল সুবাহদারগণ সবসময় সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব সহকারে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। কিন্তু একজন নায়েব কোনো সুবাদারের প্রতিরূপ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন।
বাংলায়, বিশেষ করে আঠারো শতকের প্রথম থেকে কোনো অনুপস্থিত সুবাহদার বা নাজিমের পক্ষে কর্ম পরিচালনার জন্য নিযুক্ত ব্যক্তি নায়েব বলে অভিহিত হতেন। নায়েব থেকে নওয়াব শব্দের উৎপত্তি। মুর্শিদকুলী খান (১৭১৬-১৭২৭) ও তাঁর পরবর্তীকালে বাংলায় প্রত্যেক সুবাহদারের নামের পূর্বে নওয়াব শব্দটি যুক্ত হতে থাকে।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে ইংরেজরা ঢাকা অধিকার করে। তারা ঢাকানগরী অধিকার করেই শাসন কার্যে মনোযোগ প্রদান না করে পর্তুগীজ প্রভৃতি বৈদেশিক বণিকদিগের বাণিজ্য কুঠিগুলি অধিকার করে কোম্পানির বাণিজ্য চালাতে থাকে।
ঢাকার শাসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত আগের মতোই চলতে থাকে। শাসন কাজের সুবন্দোবস্ত ও রাজকর আদায়ের জন্য দুটি বিভাগ স্থাপিত হয়- হুজুরি ও নিজামত বিভাগ। হুজুরি বিভাগ প্রাদেশিক দেওয়ানখানার অধীন হয়। দেওয়ানখানা মুর্শিদাবাদে স্থাপিত থাকে। ঢাকায় আগের মতো ডেপুটি দেওয়ানের কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজামতের সেরেস্তা ডেপুটি দেওয়ানের অধীন হয়। প্রদেশের কর সংগ্রহ ও ভূমির বন্দোবস্তের কাজ ডেপুটি দেওয়ানের হাতে থাকে। নিজামতের হাতে থাকে ফৌজদারি ও দেওয়ানী বিচারের ভার।
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে রেভিনিউ-বোর্ড রাজস্ব পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করে। ঢাকা বিভাগের রাজস্ব পরিদর্শক (Superintendent of Revenue) ঢাকা আসলে হুজুরী ও নিজামত উভয় বিভাগ তার অধীন ন্যস্ত হয়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেণ হেষ্টিংস বাংলার গভর্ণর হয়ে রাজস্ব পরিদর্শকের পদগুলি উঠিয়ে দেন ও কালেক্টরের পদ সৃষ্টি করেন। সেই সময় দেওয়ানী আদালতেরও সৃষ্টি হয় এবং কালেক্টর তার কর্তা (Superintendent) হন। মুর্শিদাবাদের রাজধানীও এসময় কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।
১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এই মন্ত্রিসভার অধীনে স্থানে স্থানে নায়েব নিযুক্ত হয়। নায়েব ইজারাদার হতে রাজস্ব সংগ্রহ করতে থাকেন। এই নায়েবদের উপর দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতা প্রদত্ত হয়। মন্ত্রিসভার উপর থাকে আপীল শুনবার ক্ষমতা।
ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় কালেক্টর পদ সৃষ্টির মাত্র দুই বছর পর বাংলায় নায়েব পদটি সৃষ্টি হয়। সে হিসেবে রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে এই পদটি সৃষ্টি হয়েছিল আড়াইশো বছর আগে।
পরবর্তীতে কালেক্টরকে সহায়তা করার জন্য রাজস্ব আদায়ের জন্য অতিরিক্ত তহসিল স্থাপন করা হয়। উক্ত অতিরিক্ত তহসিলের দায়িত্বে থাকতেন একজন তহসিলদার। তাতে করে কালেক্টরের উপর রাজস্ব আদায়ের চাপ কিছুটা কমে আসায় অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মনোনিবেশ করতে তার সুবিধা হয়।
একজন তহসিলদার, তালুকদার বা মামলতদার হলেন একজন ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তা যার সাথে রাজস্ব পরিদর্শক থাকে। তারা ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত একটি তহসিল থেকে কর প্রাপ্তির দায়িত্বে থাকেন। একজন তহসিলদার তহসিলের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও পরিচিত।
শব্দটি মুঘল আমলের বলে ধারণা করা হয় এবং সম্ভবত এটি “তহসিল” এবং “দর” শব্দের মিলন। “তহসিল” একটি আরবি শব্দ যার অর্থ “রাজস্ব সংগ্রহ”, এবং “দার” একটি ফারসি শব্দ যার অর্থ “একটি পদের ধারক”।
ব্রিটিশ শাসনামলে একজন তহসিলদার সরকারের রাজস্ব বাড়াতে নিযুক্ত কর্মকর্তা ছিলেন। পদটিকে গোয়া এবং মহারাষ্ট্রের কিছু অংশে মামলতদার বলা হত। তহসিলদার ভারতের কিছু রাজ্যে তালুকদার নামেও পরিচিত। আসাম, বাংলা এবং ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশে একজন তহসিলদারকে মৌজাদার বলা হয়। এখন ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যে তহসিলদার হলেন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার। উত্তরপ্রদেশে তহসিলদারকে সহকারী কালেক্টর গ্রেড ১-এর ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাদের বিচারিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়। তারা তালুকের বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়ন করেন এবং জেলা কালেক্টরের অধীন। তহসিলদার পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তারা জমি, কর এবং রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে সভাপতিত্ব করেন। উত্তরপ্রদেশে নায়েব তহসিলদার থেকে তহসিলদার পদে পদোন্নতি হয়। পরে তারা সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট পদে পদোন্নতি পান। গোয়াতে মামলতদার তালুকের রাজস্ব অফিসের প্রধান। যদিও প্রতিটি তালুকে একজন মামলতদার থাকে সেখানে বেশ কিছু যৌথ মামলতদারও থাকে এবং তাদের মধ্যে কাজ বণ্টন করা হয়।
পাকিস্তানে তহশিল হলো দ্বিতীয় স্তরের প্রশাসনবিভাগ। পাকিস্তানে তহশিলকে আবার উপ-বিভাগে ভাগ করা হয় যাকে ইউনিয়ন কাউন্সিল বলে। পাকিস্তানে কয়কটি তহশিল মিলিয়ে একটি জেলা গঠিত হয়। সিন্ধ প্রদেশে তহশিল শব্দটির পরিবর্তে তালুকা শব্দটিও প্রয়োগ করা হয়। তহশিল বা তালুকার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাকে তহশিলদার বলা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ভারত এবং পাকিস্তানে তহশিলদারগণ ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে কাজ করেন। ইতিপূর্বে এই পদটি বাংলাদেশে ছিলো। ১৯৫০ সালে জমিদারী অধিগ্রহণের পর তহসিলদার হিসেবে বিধিবদ্ধ পদটি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় বাংলাদেশে ২০০২ সালে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে পদবির পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড পদ।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ল্যান্ড অফিসার্স এসোসিয়েশন