আর মাত্র চার দিন পরই পহেলা বৈশাখ। চৈত্র মাসের শেষ সময়ের জন্য পালপাড়ার বাসিন্দারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। বৈশাখী মেলায় গ্রাম-বাংলার একটা বড় অংশ জুড়েই দেখা যায় মৃৎশিল্পের আবেদন। বছরের অন্য সময় মাটির তৈরি প্রয়োজনীয় অনেক তৈজসপত্র খুঁজে পেতে কষ্ট হলেও বৈশাখ মাসে সহজেই হাতের কাছে তা পাওয়া যায়। কিন্তু হারিয়ে যেতে বসা মৃৎশিল্পীরা এখনো বেঁচে আছেন বাংলা নববর্ষকে ঘিরে। পহেলা বৈশাখের দিন থেকে শুরু করে পুরো বৈশাখ মাস জুড়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে সমারোহের সঙ্গে বৈশাখী মেলা হয়ে থাকে।
কয়েক বছর আগেও পয়লা বৈশাখ ঘিরে এ সময়টাতে দম ফেলার ফুসরত মিলত না কুমারদের। হাতে তৈরি ও রং করে আগুনে পোড়ানোসহ ক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ পড়ে অনেক। কিন্তু বিক্রি করতে হয় কম দামে। এতে খরচের টাকা ওঠানোই দায় বলে দাবি শিল্পীদের। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি চলত কর্মযজ্ঞ। এই দিনগুলো শুধুই এখন স্মৃতি। দিন বদলের পালায় মাটির তৈরি এসব জিনিসের প্রয়োজনীয়তা যেন ফুরিয়ে গেছে। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, সিলভার, মেলামাইন ও চিনামাটির সামগ্রী। ফলে বাংলা নববর্ষ দরজায় কড়া নাড়লেও কর্মযজ্ঞ নেই পালপাড়ায়।
শিল্পের আগ্রাসনে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্লাটিক আর মেটাল দ্রব্যের ছড়াছড়ি থাকলেও মাটির তৈরি তৈজসপত্র হারিয়ে যায়নি একেবারে। অতীতের তুলনায় বর্তমানে ব্যবহার কম হলেও মাটির তৈরির তৈজসপত্রের প্রয়োজনীয়তা গ্রামীণ পরিবারে রয়ে গেছে এখনো। এছাড়া শহরে পরিবারেও ঘর সাজানোর সামগ্রী হিসেবে বেশ চাহিদা রয়েছে মাটির তৈরি নানা জিনিসপত্রের। আর এ কারণেই এখনো টিকে রয়েছে গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্য।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা আকচা ইউনিয়নের পালপাড়ায় এক সময় সবচেয়ে বেশি মাটির পণ্য তৈরি হতো। এখানে শতাধিক কারিগর তৈরি করতেন মাটির জিনিসপত্র। এখন অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আবার বংশ পরম্পরায় কেউ কেউ এই শিল্প ধরে রেখেছেন।
পালপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বেশকয়েকটি পরিবারের সদস্যরা নিপুণ হাতে মাটির তৈরি ফুলদানি, হাতি, ঘোড়া, গরু, পাখি, পুতুল, ব্যাংক, মাছ, পেঁপে, কলাসহ বিভিন্ন খেলনা তৈরি করছেন। পাশাপাশি রং তুলির শেষ আঁচর দিচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, কাদামাটির এ শিল্প হারিয়ে হওয়ার পথে। পুরো পালপাড়ায় হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার হাতি, ঘোরা, পুতুল তৈরি করেন। বেচাবিক্রি তেমন হয় না। এ পেশার মানুষের জীবন ধারণ করার মতো সচ্ছলতা নেই। ফলে বৈশাখেও পালপাড়ায় পাইকারদের আনাগোনা নেই। হারিয়ে গেছে এখানকার প্রাণচাঞ্চল্য।
মৃৎশিল্পীরা জানান, এক সময় পাইকাররা বৈশাখের আগে আমাদের এখানে ভিড় করতেন। এখন আর পাইকার আসেন না। পালপাড়ায় এমন দুরবস্থা হবে কোনো দিন কল্পনা করিনি। এখন চাহিদামতো আঠাল মাটি পাওয়া যায় না। দূরের গ্রাম থেকে মাটি আনতে হয়। মাটির অনেক দাম, শ্রমিকেরও দাম বেড়েছে। গত দুই বছর করোনার কারণে কোনো বৈশাখী মেলা না হওয়ায় খেলনা বা শোপিচ জাতীয় পণ্য বিক্রি হয়নি। এতে দু’বছর পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়েছে। এ সময় এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দেনা আরও বেড়েছে। তবে এ বছর কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও ক্রেতারা আসেন না। নিজেই বিভিন্ন মেলায় গিয়ে বিক্রি করি।
ঠাকুরগাঁও কালচারাল অফিসার সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে সরকার কাজ করছে। দেশি কৃষ্টি আর স্বকীয়তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মাটির বাসন কোসন। এ শিল্প যাতে বিলুপ্ত না হয় সেদিকে আমাদের নজর আছে।