বাংলাদেশের দুই রাজনৈতিক দিকপাল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক রহমান। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করলে কিশোর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। সেই কিশোর বয়স থেকে মায়ের সঙ্গে জীবন সংগ্রামের জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও বিলাসী, আরাম আয়েশের জীবনকে বেছে নেননি তারেক রহমান। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশনেত্রী মায়ের ছায়াতলে থেকে কাজ করছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। যার কারণে বাবা জিয়াউর রহমানের মতো তিনিও বারবার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। জেল, নির্যাতিত এমনকি নির্বাসনেও থাকতে হয়েছে তারেক রহমানকে। তবুও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি।
শহীদ প্রেসিডেন্ট বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দিক-নির্দেশনায় দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তার নাম বরাবরই আলাদা গুরুত্ব পায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মায়ের সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর বন্দী দশায় থাকেন। শিশু বয়সেই কারাবন্দী হওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে রাজনৈতিক বাস্তবতার খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে।
ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল এবং কলেজে পড়াশোনা শেষ করে তারেক রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলা ইউনিটে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দিয়ে বিএনপির তৃণমূল রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে মা বেগম জিয়ার সঙ্গে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রচারণায় অংশ নেন।
২০০১ সালের আগে তারেক রহমান ঢাকায় একটি গবেষণা ইউনিট গড়ে তোলেন। সেখানে স্থানীয় সমস্যা, সুশাসন, নীতি-প্রস্তাব ও তৃণমূল মানুষের মতামত সংগ্রহ শুরু করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি চালু করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে বিএনপি। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার সুযোগ থাকলেও তারকে রহমান কখনও মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্যপদ নেননি। বরং দলের কাঠামো শক্তিশালী করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য।
সব পথ যেন মিশেছে ৩০০ ফিট সড়কে
২০০২ সালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া, পরে তৃণমূল সম্মেলন আয়োজন, কৃষক ভর্তুকি ও সামাজিক ভাতা বিষয়ে প্রচার, প্লাস্টিক ব্যাগ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারেক রহমান বিশাল সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করেন। তিনি লিখিতভাবে প্রায় ১৮ হাজার কর্মীর চিঠির উত্তর দেন, যা নেতৃত্বের মানবিক ধারা হিসেবে বেশ আলোচিত হয়। কিন্তু ২০০৭–৮ এর ওয়ান ইলেভেনের সরকার তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। গ্রেপ্তার, অবর্ণনীয় নির্যাতন তার রাজনৈতিক যাত্রাকে কঠিন করে তোলে। বিএনপির দাবি তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে এমন অপতৎপরতা বাস্তবায়ন করা হয়। ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে মিথ্যা মামলায় তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টস্থ মইনুল রোডের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডে থাকাকালীন তারেক রহমানের ওপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। মেরুদণ্ড, পাঁজর ও হাঁটুতে গুরুতর আঘাতে তিনি প্রায় পঙ্গুত্বের পর্যায়ে পৌঁছান। দীর্ঘ ১৮ মাসের কারাভোগ ও অমানবিক নির্যাতনে যখন তারেক রহমান প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি, তখন আদালতের নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনে যেতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু সেই যাত্রা ছিল না কেবল চিকিৎসার, সেটিই হয়ে ওঠে জন্মভূমি থেকে এক দীর্ঘ বিচ্ছেদের শুরু।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকারি মিডিয়া এবং পাঠ্যপুস্তকে তারেক রহমানকে নিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হয় যে, জনমানসে তারেক রহমান সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অন্তত অর্ধশতাধিক মামলা এবং বেশ কিছু মামলায় সাজাও দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী সরকার দেশের গণমাধ্যমে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠ উন্মোচিত হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর।
নির্বাসনে থানা অবস্থায় ২০০৯ সালে বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ধীরে ধীরে বিএনপির পুনর্গঠনে যুক্ত হন। ২০১৮ সালে আওয়ামী সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে বন্দী করে, তখন তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন মনোনীত করা হয়। তখন থেকেই তিনি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। কিন্তু হাসিনার সরকার ওয়ান ইলেভেন সরকারের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় তাকে একে পর এক দণ্ডাদেশ দেয়। তারপরও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণে এবং নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখেন তিনি।
দেশের বাইরে থেকেও তারেক রহমান রাজনীতি থেকে এতট বিচ্ছিন্ন হননি। ভার্চুয়াল সভা, ভিডিও কনফারেন্স ও সরাসরি দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ড. জুবাইদা রহমানের স্বামী ও জাইমা রহমানের পিতা। পড়াশোনা, সংগীত, সংস্কৃতি ও পোষা প্রাণীর প্রতি তার অনুরাগ তাকে আরও মানবিক, শান্ত ও চিন্তাশীল চরিত্রে তুলে ধরে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তার প্রতিটি বিবৃতি দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ওঠে। রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা ও অপপ্রচার সত্ত্বেও তারেক রহমান কোটি সমর্থকের কাছে এখনও এক আপোষহীন নেতা।
দীর্ঘ ১৭ বছরের বেশি সময় যাকে ঘিরে অপেক্ষা, আকুতি, অভিমান আর প্রত্যাশা, অবশেষে সেই মানুষটি ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন। তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কেবল একটি ব্যক্তি বা দলের ঘটনা হবে না, বরং তা হবে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির এক বিশাল বাঁক বদল।
