গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি:
গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী – গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ঢাকা–রংপুর মহাসড়কের ফাসিতলা ও কোমরপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি কলার হাট। এই হাট এখন উত্তরবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন ভোর থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে দরদাম,ট্রাকে কলা বোঝাইয়ের ধুম। এই মহাসড়কসংলগ্ন হাটকে ঘিরে এখন জমজমাট গাইবান্ধার কৃষি বাণিজ্য খাত । সপ্তাহে দুই দিন মূল হাট বসলেও প্রায় প্রতিদিনই চলে কলা কেনাবেচা। কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও পাইকারদের আনাগোনায় পুরো এলাকা থাকে উৎসবমুখর। প্রতিদিন এই হাট থেকে শতাধিক ট্রাক ভর্তি কলা চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, এমনকি কক্সবাজার সহ দেশের প্রায় সব জেলায় পাঠানো হয়।
বেচাকেনার পরিমাণ প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছায়। স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়,পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে বহু কৃষক আজ কলা চাষ করে জীবন বদলে ফেলেছেন। একসময় যারা ধান বা আলু চাষ করতেন, তারা এখন কলার বাগান গড়ে তুলেছেন, কারণ এর বাজার কখনো পড়ে না অর্থাৎ বছর জুড়ে চাহিদা থাকায় ভালো দামে বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে চলতি বছরে রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে জেলার ৯২৬ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির কলার চাষ হয়েছে। ফসিতলা হাটের কৃষকরা বলেন, আগে দূরদূরান্তে কলা বিক্রি করতে যেতে হতো; এখন পাইকাররা নিজেরাই হাটে এসে কিনে নিয়ে যান। স্থানীয় কৃষক আব্দুল করিম বলেন, “আগে আমাদের কলা বিক্রি করতে গিয়ে ভোগান্তি হতো। এখন হাটের কারণে সবকিছু সহজ হয়েছে। পাইকাররা এসে দর ঠিক করে নিয়ে যায়, এতে পরিবহন খরচও বাঁচে।”
এ অঞ্চলের কৃষকরা এখন কলা বিক্রির টাকায় সন্তানদের লেখাপড়া, ঘর নির্মাণ এমনকি নতুন বাগান করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন। ফলে কৃষি অর্থনীতিতে একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি ফাসিতলা হাটে কলা বোঝাই ট্রাকের সারি দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে কলা কিনে বড় বড় ট্রাকে করে পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। স্থানীয় পাইকার হোসেন আলী বলেন, “এই হাটে প্রতিদিন কোটি টাকার কলা বিক্রি হয়। উত্তরের প্রায় সব জেলার কলা এখান দিয়েই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফাসিতলা এখন উত্তরবঙ্গের কলা রাজধানী।” কিছু পাইকার আবার বলেন, এখানে কলার গুণগত মান ভালো থাকায় ক্রেতাদের চাহিদা বেশি। হাটে কলা বিক্রি করতে আসা সাইফুল আলম শাহিন বলেন , “এ বছর ৭০ শতক জমিতে কলা চাষ করেছি । আবহাওয়া ভালো থাকায় ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। হাটে প্রতি কাদি চিনি চম্পা কলা আকারভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে” ।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আতিকুল ইসলাম বলেন, “গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার মাটি কলা চাষের উপযোগী। কলার চাষ কৃষক – শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে।”এছাড়া হাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল কর্মসংস্থান। প্রতিদিন শত শত শ্রমিক কলা তোলা , ট্রাকে বোঝাই কাজে নিয়োজিত। এছাড়া হাটের আশপাশে ছোটখাটো দোকান, খাবার হোটেল ও গ্যারেজও গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করছে” । তবে হাটের এই গুরুত্বের তুলনায় অবকাঠামো এখনো অনুন্নত।
সড়কের দুই পাশে স্থায়ী দোকান বা ট্রাক পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, “এত বড় এই হাট, কিন্তু এখানে সরকারি কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নেই। যদি সরকার একটু উদ্যোগ নিত, তাহলে এখানে আন্তর্জাতিক মানের কলা বাজার গড়ে তোলা যেত।” আর্থিকখাত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গাইবান্ধার কলার হাট শুধু একটি স্থানীয় বাজার নয় এটি বাংলাদেশে কলা রপ্তানির সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হতে পারে। এখানকার কলা রঙ, আকার ও স্বাদে উন্নতমানের, যা বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে। যদি সরকার ও বেসরকারি খাত একযোগে কাজ করে, তবে “গোবিন্দগঞ্জের কলা ” হতে পারে দেশের একটি ব্র্যান্ড।
