ওলি-আউলিয়ার পবিত্র নগরী সিলেট। ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা, সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির অনন্য এক মেলবন্ধন এই শহরে। সিলেটবাসীর কাছে এই শহর শুধু ভালোবাসার নয়, গৌরবেরও। তবে এই ভালোবাসার শহরটিই যেন কিছু সমস্যায় হারিয়ে ফেলছিল নিজের গর্বিত মুখচ্ছবি। রাজপথে ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য, ফুটপাত দখল করে হকারদের অনিয়ন্ত্রিত দখলদারি আর তীব্র যানজটে হাঁসফাঁস করছিল সাধারণ নাগরিক জীবন।
এই নগরের সৌন্দর্য যখন গলাটিপে ধরা পড়তে শুরু করেছিল দৈনন্দিন অব্যবস্থাপনায়, তখনই আশার বাতি হয়ে আবির্ভূত হলেন সিলেট মহানগর পুলিশের নতুন কমিশনার মো. আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি নজরে এনেছেন নগরের বাস্তব চিত্র। ব্যতিক্রমী কৌশলে শুরু করেন জনসম্পৃক্ততা। হেলমেট পরা বাইকারদের হাতে ফুল দিয়ে জানান শুভেচ্ছা। তারপরের গল্পটা আর পেছনে ফিরে তাকানোর নয়। হকার ও অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় লাগাতার অভিযান। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই উচ্ছেদ করা হয় শত শত অবৈধ রিকশা।
কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে নাগরিক জীবন। যানজটের ভিড়ে খুঁজে মেলে শৃঙ্খলার ছায়া। তবে আবদুল কুদ্দুছ থেমে যাননি শুধু রাস্তা পরিষ্কারে। তিনি বুঝেছেন-সমস্যা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং ব্যবস্থাপনাগতও। মানুষ পুলিশকে ভয় পায়, থানায় যেতে দ্বিধা বোধ করে, কারণ দীর্ঘদিন ধরে সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে পোহাতে হয়েছে নানা দুর্ভোগ। এই বৈষম্য দূর করতে, জনগণকে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে, আর আধুনিক প্রযুক্তিকে মানবিক সেবায় রূপ দিতে তিনি চালু করেন ‘জিনিয়া’ অ্যাপ। ‘জিনিয়া’ শুধু একটি মোবাইল অ্যাপ নয়, এটি এক নতুন ভাবনার নাম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম, মানুষ ঘরে বসেই পুলিশের সেবা চাইতে পারছে এক ক্লিকেই। বিপদের মুহূর্তে এসওএস বাটনে চাপ দিলেই বার্তা পৌঁছে যাবে এসএমপির কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে। আবার চাইলেই যেকেউ দিতে পারবেন তথ্য বা অভিযোগ, যেটি সরাসরি পৌঁছে যাবে পুলিশ কমিশনারের নজরে। এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসী পরিবার থেকে শুরু করে গৃহবধূ, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী-সকলেই পাবেন হাতে-নাতে সহায়তা।
আর এই সেবাকে আরও বিস্তৃত করতে চলছে এক মহাযজ্ঞ প্রচেষ্টা। সকল মানুষের মধ্যে ‘জিনিয়া’ অ্যাপের ব্যবহার ও সচেতনতাবার্তা পৌঁছে দিতে ছাপানো হয়েছে এক লক্ষ লিফলেট। ৭শ’ মসজিদে জুমু’আর শেষে মুসল্লিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৩০ হাজার লিফলেট। শুধু মুসলিম ধর্মীয় উপাসনালয়েই নয় সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে নিরাপত্তা ও সেবা পৌঁছে দিতে চায় এসএমপি। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য উপাসনালয়েও আরও ১০ হাজার লিফলেট বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রচারণার অংশ হিসেবে সিলেট শহরের ১৫০টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্যানার টানানো, নগরীর এলইডি স্ক্রিন গুলোতেক এক সপ্তাহব্যাপী অ্যাপের প্রমোশনাল ভিডিও প্রচারেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও জিনিয়া অ্যাপ নিয়ে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হবে। এতে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিনির্ভর পুলিশের সেবা সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে এবং পুলিশের সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এসএমপি জানিয়েছে, প্রচার কার্যক্রম শুধু মাঠ পর্যায়ে নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমানভাবে চলবে।
ভিডিও, পোস্ট এবং লাইভ সেশনের মাধ্যমে জিনিয়া অ্যাপের ফিচার, ব্যবহার পদ্ধতি এবং নাগরিক সেবার দিক তুলে ধরা হবে। কমিশনার আবদুল কুদ্দুছ ‘দৈনিক একাত্তরের কথা’কে বলেন, জিনিয়া অ্যাপ শুধুই প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি একটি মানবিক পুলিশের প্রতিচ্ছবি।
মানুষ আর যেনো থানায় দৌড়াতে না হয়। পুলিশ মানুষের দ্বারে দ্বারে দৌড়াবে সেবা দিতে। এতেই প্রমাণীত হবে পুলিশ জনগনের বন্ধু। সিলেট সবসময়ই ছিল দেশের রাজনীতির সূচনা বিন্দু। নির্বাচনের শুরুর মঞ্চ হয় এখান থেকেই। আর এবার এক নতুন পুলিশিং পদ্ধতির সূচনাও হলো এখান থেকে। কমিশনারের ভাষায়, পুলিশের একার চেষ্টায় সম্ভব নয়, নাগরিক অংশীদারিত্বই গড়ে তোলা সম্ভব একটি নিরাপদ, স্মার্ট ও আধুনিক সিলেট।