নিজস্ব প্রতিনিধি: নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সোমেশ্বরী। মহাশোল মাছের জন্য একসময়ের বিখ্যাত এই নদী সময়ের বিবর্তনে তার সৌন্দর্য আর স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়েছে। সোমেশ্বরীর বুক থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে নদীটি পরিণত হয় মরা খালে। তবে গত প্রায় দেড় বছর বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় ধীরে ধীরে নদীটি প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
সোমেশ্বরী নদীতে বর্তমানে নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য জলজ প্রাণীরও দেখা মিলছে নদীতে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিদিন নদীতে ছোট ছোট নৌকায় বসে মাছ ধরছেন। নদীর চর থেকে কয়লা আহরণ করছেন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় নদীতে ড্রেজার নেই। ফলে বিকট শব্দও নেই। নদী তীরবর্তী মানুষ এখন স্বস্তি পেয়েছেন। স্থানীয় মানুষেরা বিকেলবেলায় সোমেশ্বরীর পাড়ে এসে চমৎকার নাগরিক সময় কাটাতে পারেন। নদীর নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে তাদের মন। সবমিলিয়ে ধীরে ধীরে নদীর জীববৈচিত্র্য ফেরায় জনমনে প্রশান্তি বিরাজ করছে।
তবে দেড় বছর আগেও সোমেশ্বরী নদী ছিল চারপাশে ড্রেজারে ঘেরা এক আশ্চর্য মৃত নদী। যেখানে দিনরাত ড্রেজারের বিকট শব্দ আর শত শত বালুবাহী ট্রাক-লরিই ছিল প্রতিদিনের বাস্তবতা। তখন মূলত নদী বলে কিছু ছিলনা। সোমেশ্বরী তখন ছিল এক ধূ ধূ মরুভূমি এবং পরিবেশের দূষণ ছিল চরম মাত্রায়। বর্ষা মৌসুমে নদীর দুপাড়ে ভাঙ্গণের মাত্রাও তীব্র ছিল।
সোমেশ্বরী নদীর বালুমহাল নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বিগত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল। তারা নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নদীতে যেখানে সেখানে অসংখ্য ড্রেজার বসিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতেছিল। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে সৃষ্ট গভীর খাদে পড়ে ঘটেছে অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা।
এছাড়া বিরিশিরি-শ্যামগঞ্জ সড়কে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চলাচলের ফলে প্রায়ই ঘটতো দুর্ঘটনা। অসংখ্য মানুষ ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে সড়কে প্রাণ হারিয়েছে। বালুমহাল বন্ধ থাকায় গত এক বছরে তেমন দুর্ঘটনা নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার একটি রিট পিটিশন মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশে গত বছরের এপ্রিল থেকে বালু উত্তোলন ও ইজারা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহন মিয়া বলেন, সোমেশ্বরী নদীর বুকে সৃষ্ট ক্ষতচিহ্নগুলো ধীরে ধীরে সেরে ওঠায় নদী এখন তার রূপ ফিরে পাচ্ছে। আমাদের কাছে নদীর এই পুনর্জাগরণ স্বপ্নের মতোই।
পরিবেশকর্মী পল্টন হাজং বলেন, নদীখেকোদের হাত থেকে সোমেশ্বরীকে বাঁচাতে হবে। নদী তীরবর্তী গ্রাম,ফসলি জমি ও মানুষের বসতি বাঁচাতে হলে সোমেশ্বরী নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের সুযোগ দেয়া যাবেনা।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখানের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল নদীটিকে বাঁচানোর। সেই মোতাবেক বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি হবে। সে অনুযায়ী নদীকে বাঁচিয়ে রেখে এর ব্যবহার কী করে করা যায়, সেটির একটি প্রকল্প তৈরি করে পাঠানো হবে।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা আফসানা বলেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সোমেশ্বরী একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই নদী প্রাণ ফিরে পাচ্ছে,যেটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
সোমেশ্বরী প্রাণ ফিরে পাওয়ায় নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ও জীববৈচিত্র্য ধীরে ধীরে আগের মতো ফিরবে- এমনটাই প্রত্যাশা করছেন স্থানীয়রা। নদীটি রক্ষায় সরকার সদা সচেষ্ট থাকবে- এটিই তাদের প্রাণের দাবি।