গাইবান্ধা প্রতিনিধি:
গাইবান্ধার বিভিন্ন গ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাম্য শালিস বা সালিশি বৈঠকের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, পারিবারিক ও জমি-সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য বহু বছর ধরে গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত এই শালিস এখন অনেক ক্ষেত্রেই রূপ নিচ্ছে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায়।
বিশেষত নারী, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এসব শালিসে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন। সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, সুন্দরগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর উপজেলার একাধিক গ্রামে সালিশের নামে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া, খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, অমানবিক জরিমানা, প্রকাশ্যে অপমান, এমনকি গ্রাম থেকে বিতাড়িত করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ—এসব শালিসে প্রভাবশালী মহল নিজের স্বার্থ রক্ষায় ‘আইনের বাইরে’ গিয়ে বিচার করে থাকে।

এতে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার তো পানই না, বরং নতুন করে ভোগান্তির শিকার হন। বিবাহ বিচ্ছেদ, নারী-পুরুষ সম্পর্ক বা পারিবারিক দ্বন্দ্বের মতো বিষয়ে সালিশের রায়ে নারীদের শাস্তিই সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক সময় তাদের চুল কেটে দেওয়া, গ্রামে প্রবেশে বাধা দেওয়া বা প্রকাশ্যে অপমান করা হয়। এ ধরনের শাস্তি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, বরং নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।
গ্রাম্য শালিসে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৫ দিনে শুধুমাত্র গাইবান্ধা জেলাতে চারটি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে যেখানে কথিত সমাজপতিরা দেশের প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে ভুক্তোভোগীদের হেনস্থা করছে । পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ গ্রাম্য শালিস বসে নারী পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে বিচারের নামে চলে অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। গ্রাম্য শালিসে কথিত সমাজপতি কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হওয়া এমন কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়।
সবগুলো ঘটনায় নারীর প্রতি অবমাননা ও নাগরিক হিসেবে তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। ২৬ আগষ্ট গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় সাবেক দুই দম্পতিকে বাজার থেকে তুলে খুঁটিতে বেধে মারপিট করে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ঐ নারীর মা জানান ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে তালাক প্রাপ্তা ওই নারী কাপড়-চোপড় কেনার জন্য গোবিন্দগঞ্জে আসে। 

এই সুবাদে ঐ নারীর সাবেক স্বামী মিলন মিয়াও আসে। তাদের দেখা হওয়ার এক পর্যায়ে সাবেক স্বামী মিলন মিয়া ও সাবেক স্ত্রীর গল্প করাকালে সরকার পাড়ার শাহারুল ইসলাম সরকার ও সাদা মিয়া সরকারসহ আরও কয়েকজন মিলে গোবিন্দগঞ্জ উত্তর বাসষ্ট্যান্ড থেকে তাদেরকে জোরপূর্বক বাড়িতে নিয়ে আটক রেখে লাঠি ও লোহার রড দ্বারা উভয়কে বেধরক মারপিট করে।
এরপর ওই নারী ও সাবেক স্বামী মিলন মিয়াকে বারান্দার সিমেন্টের খুঁটির সাথে রশি দ্বারা বেধে প্রকাশ্যে গ্রামের মানুষের সামনে চুল কাটা মেশিন দিয়ে সাবেক স্ত্রী ও মিলন মিয়ার মাথার চুল কেটে ন্যাড়া করে দিয়ে তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর থেকে ভুক্তভোগী ঐ নারী এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে।
এবং গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছে। এই ঘটনার পরদিন ২৭ আগষ্ট গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে সৌদি প্রবাসী দুই সহোদর ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে পরকীয়া করতে গিয়ে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে দুই বন্ধু। ঘটনার সময় উত্তেজিত গ্রামবাসী চারজনকেই রশি দিয়ে বেঁধে রাখে। পরে তাদের মাথা ন্যাড়া করে গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরানো হয়। এসময় অনেকে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ওই দুই যুবক ও সংশ্লিষ্ট দুই গৃহবধূকেও আটক করে আদালতে প্রেরণ করে।
এর আগে সদর উপজেলার বালিয়াখালি ইউনিয়নে ধর্ষণের শিকার এক যুবতীর সাথে ধর্ষকের বিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে কথিত সমাজপতিদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়। রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা কর্মীরা জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ মিমাংসা করতে গিয়ে টাকার বিনিময়ে সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে ভুক্তোভোগীদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছে।
গাইবান্ধা জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম প্রধান বলেন, গ্রামীণ সমাজে সালিশি বৈঠকের নামে চলমান এ ধরনের অমানবিক শাস্তি বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা এবং গ্রামীণ জনগণকে সহজলভ্য আইনি সহায়তা নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে।
গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মী সালাউদ্দিন কাশেম বলেন , বাংলাদেশে গ্রাম্য শালিস সম্পূর্ণ বেআইনি নয়, তবে আইন অনুযায়ী এটি কেবলমাত্র পারিবারিক বা সামাজিক বিরোধের সমঝোতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কোনো শারীরিক বা মানসিক শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার শালিসদের নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় মাঝে মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের কারণে বিচার কার্যকর হয়না