সুরমা নদীর শান্ত ঢেউ, আর সবুজে ঘেরা টিলার মাঝে লুকিয়ে আছে এক বিষন্নতার ছবি। সম্প্রতি সিলেট ও তার আশপাশের অঞ্চলে আত্মহত্যার ঘটনা যেনো এক নীরব মহামারীর আকার ধারণ করেছে। পারিবারিক সম্পর্কের ভাঙন, আর্থিক সংকটের চাপ, কিংবা মনের গভীরে জমে থাকা বিষাদ-এসব কিছুই যেন মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে এক অন্তহীন গহ্বরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনের প্রতি উদাসীনতা ও সামাজিক চাপের বেড়াজাল মানুষকে এই করুণ পরিণতি বেছে নিতে বাধ্য করছে।
গত সোমবার দুপুরে সিলেট নগরের চাঁদনিঘাট এলাকায় সুরমা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তানজিলা খানম নামের এক নারী, যিনি স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে জীবনের ইতি টানতে চেয়েছিলেন। তবে ভাগ্যক্রমে, স্থানীয় কিছু সাহসী মানুষ তাকে বাঁচিয়ে তোলেন। একই দিনে, হাসপাতালের অস্ত্রোপচারের ভয়ে উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৯ম তলা থেকে লাফ দিয়ে জীবন কেড়ে নিয়েছেন ৩০ বছর বয়সী ফয়েজ আহমেদ।
জীবনের প্রতি এই ভয় এবং হতাশা যেন জানান দিচ্ছে, চারপাশের জগৎটা কতটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সিলেট মহানগর পুলিশসূত্রে জানা যায়- ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছেন ৩৮ জন, বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন, উপর থেকে পড়ে মারা যান ৭ জন, পানিতে ডুবে মারা যান ১১ জন, বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ৮ জন, অজ্ঞাত বা বিবিধ কারণে মারা যান ৩৭ জন এর মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ তন্মধ্যে অজ্ঞাত পুরুষ ৮ জন, পিতৃগৃহে ২৩ জন মহিলা, স্বামী গৃহে ৭ জন এবং অজ্ঞাত ৩ জন মহিলা বিভিন্ন দূঘর্টনায় মারা যান। আত্মহত্যার এই করুণ সুর শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনেই বাজছে না, বরং এর করুণ প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে শিশু ও তরুণদের জীবনেও।
সম্প্রতি সিলেট নগরীর কানিশাইল এলাকায় বাবার সাথে সামান্য অভিমান করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী রেশমা বেগম। অন্যদিকে, পরিবারের শাসনের প্রতি অভিমান করে একই পথ বেছে নিয়েছে ১৬ বছর বয়সী ইতি দাশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই কোমলমতি মনগুলোর ওপর চাপানো পড়ালেখার বোঝা, অভিভাবকদের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা এবং মনের কথা বলার মতো নিরাপদ স্থানের অভাবই এমন মর্মান্তিক ঘটনার কারণ।
অন্যদিকে, ২৫ জুন ওসমানীনগরে মানসিক রোগে ভুগতে থাকা ৫২ বছর বয়সী ছায়াদ মিয়া নিজের স্ত্রীকে কুপিয়ে আহত করার পর আত্মহত্যা করেন। এটি যেন মানসিক রোগের ভয়াবহতাকেই সামনে নিয়ে আসে। একইভাবে, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে ভালোবেসে বিয়ের মাত্র চার মাসের মাথায় ১৭ বছর বয়সী সেতু মিয়ার আত্মহত্যা সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং মানসিক নির্যাতনের এক করুণ চিত্র তুলে ধরে।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, সম্পর্ক যখন বিষাক্ত হয়ে ওঠে, তখন তরুণ মনগুলো সহজেই হতাশায় ডুবে যায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ফজিলাতুন নেসা বলেন, পরীক্ষায় খারাপ ফল, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তি এবং নেশার জালে জড়িয়ে পড়া-এসবই মূলত আত্মহত্যার প্রধান কারণ। মানুষ যখন আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন সামান্য প্রতিকূলতাও পাহাড় সমান মনে হয়। তিনি আরও বলেন, উচ্চশিক্ষার পর চাকরির অভাব এবং সমাজে ব্যক্তিগত সম্পদের বৈষম্যও এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামও একই সুরে বলেন, বেকারত্ব, মাদকের নেশা, পারিবারিক কলহ এবং প্রেমঘটিত সম্পর্ক-এসবই বেশিরভাগ আত্মহত্যার ঘটনার পেছনে কাজ করে। এই বিষাদময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, পারিবারিক সম্পর্কগুলোয় আরও যত্নশীল হওয়া এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, বরং এটি একটি গভীর ক্ষত যা কেবল সমাজ ও পরিবারের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সারানো সম্ভব।