জেলা প্রতিনিধি:
নড়াইল: দু’বছর না যেতেই বাংলাদেশ ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত নড়াইলের কালিয়া উপজেলার কৃষকদের পার্টনার স্কুলগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। কৃষকদের পাওনা টাকা নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ খোদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে, অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিক।
কালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিকের কার্যালয়ে পার্টনার ফিল্ড স্কুলের অনিয়ম প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই তিনি বলেছেন,’আপনারা বলতে পারেন দূর্নীতি করে আমি জমি কিনছি। কৃষি অফিসার হওয়ার আগে কি সুযোগ থাকে! কৃষি অফিসার হলে অনেক কিছু সুযোগ থাকে ফাঁসায় ঠাসায় দিয়ে কথা থাকে। ভাই বাংলাদেশের সব অফিসের একই চিত্র, আমার মনে হয় আমার অফিস সেই তুলনায় অনেক ভালো।
শোনেন, আমার অফিসের উপ সহকারীদের হাতে কৃষকদের নাস্তার টাকা যদি দেই, এই নাস্তা তাদের কাছে কিভাবে যাবে বা তাদের কাছে টাকা পৌছাবে কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’ তথ্য বলছে, বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পুষ্টি উন্নয়ন, উদ্যোক্তা তৈরি, পরিবেশ বান্ধব চাষাবাদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে নড়াইলের ইউনিয়ন গুলোতে ২০২৩ সালের আগষ্টে যাত্রা শুরু করে কৃষকদের নিয়ে পার্টনার ফিল্ড স্কুল।
২৫ জন করে কৃষক নিয়ে গঠিত এসব স্কুলে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়ার কথা ছিলো। প্রতিটি স্কুলে ধান, গম, ডাল, তৈলবীজ, পুষ্টি, ভূট্টা আর গ্যাপ এই ৭ শ্রেণীর ফসল নিয়ে ১০টি ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে উপজেলা কৃষি বিভাগের মনগড়া নিয়মে কোথাও ২ দিন আবার কোথাও ৫ দিনেই শেষ হয় সেশন। কিন্তু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিকের চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত কৃষকদের পার্টনার ফিল্ড স্কুল রুটিন অনুযায়ী দেখা যায়, স্কুল গুলোর দশম সেশন শেষ হয়েছে সকাল-বিকাল পরিক্রমায় যথাক্রমে মে মাসের ৭, ৮, ১২, ১৪, ১৫, ১৮ এবং ১৯ তারিখে।
কৃষকদের অভিযোগ, কালিয়া উপজেলার পার্টনার ফিল্ড স্কুলের সাড়ে ৩০০ কৃষকের প্রত্যেকে প্রশিক্ষণ শেষের দশম দিনে সম্মানী বাবদ ২ হাজার টাকা এবং নাস্তা দেয়ার কথা থাকলেও তা না দিয়ে প্রতি ক্লাসে নাস্তা বাবদ ৮০ টাকা বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়। খাবার বাবদ প্রতি ক্লাসে ৮০ টাকা করে মোট ২ হাজার ৮০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিকের স্বেচ্ছাচারীতা আর অনিয়মের যাতাকলে ক্লাস শেষ করার পরও অদৃশ্য কোনো এক কারনে এ বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত কিছুই জোটেনি তাদের ভাগ্যে।
মাথাভাঙা পার্টনার ফিল্ড স্কুলের সভাপতি ও কৃষক মাসুদুর রহমান বলেন, রমজানের ঈদের আগে আমাদের ক্লাস শুরু হয়। আমরা শুনেছি সম্মানি বাবদ দুই হাজার টাকা করে প্রতিজন পাবো। আর প্রতি ক্লাসে নাস্তা দেয়ার কথা থাকলেও আমাদেরকে তার পরিবর্তে টাকা দেয়ার কথা। তবে, অনুসন্ধানের খবরে তড়িঘড়ি করে কৃষকদের পাওনা কিছু টাকা পরিশোধ করেন তিনি। সেখানেও স্বেচ্ছাচারিতায় মগ্ন কৃষি কর্মকর্তা। কৃষকদের সম্মানি বাবদ ২ হাজার টাকা ও নাস্তা বাবদ ৮০০ টাকার পরিবর্তে কোথাও ৪০০ আবার কোথাও সাড়ে ৪০০ টাকা সহ সম্মানি প্রদান করেন।
উড়শী পার্টনার স্কুলের দীপ্তি রানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে ২৫ জন কৃষক নিয়ে ক্লাস করানো হয়। ১০ দিন স্কুল হওয়ার কথা থাকলেও ৫ দিনে সকাল বিকাল দিয়ে ক্লাস শেষ করাইছে। রোজার ঈদের আগে আমাদের ক্লাস শেষ হইছে, কিন্তু ক্লাসের টাকা আর নাস্তার টাকা দেবে দেবে করে এতোদিন ধরে দেয়নি। শুধু এই দিচ্ছি দিবানি করে ঘুরাইছে। তবে দীপ্তি রানী বিশ্বাসের স্বামী বলেন, আপনারা আসার খবরে তড়িঘড়ি করে বড় ম্যাডাম (ইভা মল্লিক) নিজে এসে টাকা দিয়ে গেছে, ১০ মিনিট ও দাঁড়াননি। মোট ২৪৫০ টাকা করে দেছে আমাদের।
অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিক সানন্দে বলেন, ‘ভাই টাকা গুলো যে কোথা থেকে ম্যানেজ করতে হয় কিভাবে বলবো, কাউকে তো বলতে পারিনা! হিসাব রক্ষণ বিভাগে (এজি অফিস) প্রকল্পের টাকা তুলতে গেলেই ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা দিয়ে আসতে হয়। ভ্যাটে ১৫, আইটিতে ৫, অডিটে ৩, একাউন্টসে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে টাকা দিয়ে আসতে হয়। তারপরও আমি কৃষকদের ৭০ শতাংশ হারে সব পরিশোধ করি।
আর সব কিছু ম্যানেজ করতে প্রকল্প গুলো থেকে এদিক ওদিক করতেই হয়’। অভিযুক্ত এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও স্থানীয় এক সার ও বীজ ডিলারকে ঘুষ না দেয়ায় হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ প্রচারের পর খুলনা থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি দল কালিয়ায় গিয়ে এ বিষয়ে তদন্তও করেন। জানা যায়, ইভা মল্লিক কৃষি কর্মকর্তা হিসাবে কালিয়া উপজেলায় যোগদানের পর পার্শ্ববর্তী একটি সরকারি ব্যাংকে পরিবারের এক সদস্যের সঞ্চয়ী হিসাবে তিনি পৌনে দুই বছরে লেনদেন করেন মোট ২ কোটি ৬৪ লাখ ৯২ হাজার ২৮ টাকা। কিন্তু, ক্যামেরার সামনে এসব অনিয়ম আর অসঙ্গতির কথা স্বীকার করলেও ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নিতে নারাজ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিক। তিনি দাবি করেন,’আমি স্বচ্ছতার সাথে অফিস পরিচালনা করি।
তবে পার্টনার ফিল্ড স্কুল গুলোতে দশম সেশনে টাকা দেয়ার কথা থাকলেও আমি ক্লাস শেষ করিনি। টাকা যেদিন দিবো সেদিন শেষ ক্লাস রাখি। কৃষকদের টাকা দিবোনা বা দিচ্ছি না ব্যাপারটা এমন নয়। আপনারা পূর্বের রবি মৌসুমের স্কুল গুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’ পার্টনার ফিল্ড স্কুল ছাড়াও ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে শেষ হওয়া সমলয় প্রকল্প, তৈল জাতীয় প্রকল্প, খুলনা ক্লাইমেট স্মার্ট প্রকল্প, রাজস্ব প্রকল্প, পারিবারিক পুষ্টি প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিকের বিরুদ্ধে।
আর চলতি মাসের ৭ তারিখ দুদকে ওই কর্মকর্তা ঘুষ দূর্নীতির অভিযোগ এনে স্থানীয় এক সার ও বীজ ডিলার অভিযোগপত্র দেন। কালিয়া উপজেলায় পার্টনার ফিল্ড স্কুলের অনিয়ম অসঙ্গতি প্রশ্নে নড়াইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. জসীম উদ্দীন দেন দায়সারা বক্তব্য তিনি বলেন, অনিয়মের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।