ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
আবুল ফজল নামটা এখন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় এক পরিচিত মুখ। তার শরবতের দোকানে প্রতিদিনই ভিড় করছেন শত শত মানুষ। কেউ গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায়, কেউ হজমের জটিলতায়, কেউবা শারীরিক দুর্বলতা কিংবা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে শরবত পান করছেন। তার হাতে তৈরি ভেষজ উপাদানে ভরপুর এই পানীয় এখন আশেপাশের উপজেলাগুলোতেও সুনাম ছাড়িয়ে পড়ছে। উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের তাহেরপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল ফজল (৫৫)।
জীবিকার সন্ধানে এক সময় পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকায়। সেখানেই দক্ষিণ বাংলার পটুয়াখালীর কবিরাজ আব্দুল আজিজ খানের শিষ্য হয়ে হাতে-কলমে শিখেছেন ভেষজ গাছগাছড়ার গুণাগুণ আর শরবত তৈরির কলাকৌশল। প্রায় তিন বছর তিনি ছিলেন তার অধীনে। এরপর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ২০০৮ সালে রাজধানীর কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট ও বনশ্রী এলাকায় নিজ হাতে তৈরি ভেষজ শরবত বিক্রি শুরু করেন। পাঁচ বছর ওই এলাকায় বিক্রি করে পেয়েছিলেন ভালো সাড়া।
কিন্তু শহরের কোলাহল আর ভাড়াভিত্তিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাকে টেনে এনেছে নিজের গ্রামে। ২০১৩ সালে ফিরে আসেন নিজ জন্মভূমি ঈশ্বরগঞ্জে। প্রথমে তারুন্দিয়া বাজারে শরবতের দোকান দেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে ঈশ্বরগঞ্জ পৌর শহরের কৃষি ব্যাংকের সামনে গড়ে তোলেন তার ভেষজ শরবতের দোকান। এটি এখন ঈশ্বরগঞ্জের অগণিত মানুষের সুস্বাদু পানীয় এবং বনাজী চিকিৎসার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। আবুল ফজলের এই শরবতের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, ২শ ২০ প্রকার ভেষজ উপাদানের সংমিশ্রণ।
সবগুলো উপাদানই প্রাকৃতিক, রাসায়নিকমুক্ত এবং ওষুধি গুণ সম্পন্ন। প্রতিটি উপাদান আলাদা আলাদা সমস্যার বিরুদ্ধে কাজ করে। উপাদানের মধ্যেগুলোর মধ্যে রয়েছে, আমলকী, হরতকি, বহেড়া, শতমূল, অনন্তমূল, অশ্বগন্ধা, বৈকুমড়া, শিমুলমূল, জৈষ্ঠ্যমধু, অর্জুন গাছের ছাল, সোনাপাতা, বেলসুট, এলোভেরা, ভূঁই কুমড়া, তালমূল, সিলাজত, জাম ও আমের বিচি, কচি বেল, ওলটকমল, দাউদ মনি, আল্কুচরি প্রভৃতি। এসব উপকরণ তিনি রাজশাহীর নাটোর থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। এই শরবত শুধু স্বাদের জন্যই নয়, এর স্বাস্থ্য উপকারিতাও অসাধারণ।
বিভিন্ন রোগের রোগীরা প্রতিদিন আসেন তার দোকানে। তার ভাষ্য ও ত্রেতাদের অভিজ্ঞতায় শরবতটি অত্যান্ত কার্যকর। গ্যাস্ট্রিক ও হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, জন্ডিস, লিভার ও কিডনি সমস্যা, হার্ট দুর্বলতা, শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি, যৌন দুর্বলতা, হাত-পা জ্বালা-পোড়া, মহিলাদের সাদা স্রাব ভাঙ্গা, ধাতু দুর্বলতা, ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। কবিরাজ আবুল ফজল জানান, প্রতি গ্লাস শরবত ২০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার শরবত বিক্রি হয়। শরবত বিক্রির আয়ে চলে তারা সংসার।
তার তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে সুজন ঢাকায় সিএনজি চালান, মেঝো ছেলে জয়নাল গার্মেন্টসে চাকরি করেন, আর ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর ড্রাইভিং শিখছেন। তিনি বলেন, “এই ব্যবসা করে আমি আমার মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি, ছেলেদের দাঁড় করিয়েছি। শরবতের মাধ্যমে মানুষ উপকার পাচ্ছে আর আমার পরিবারও চলছে। এর চেয়ে বড় শান্তি আমার জীবনে আর কিছু নেই।” দোকানে আসা সাকিবুল হাসান সাকিব, হাসানুর রহমান, জামাল মিয়া ও লুৎফুর রহমান বলেন, এই শরবত একবার খেলেই বুঝা যায় যে কি উপকার হচ্ছে।
এই শরবতে গ্যাস্ট্রিক, ক্লান্তি, হজম সমস্যা সবই দূর হয়। এব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা সাদিয়া তাসনিম মুনমুন জানান, শরবতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে তা ঠিক আছে এবং স্বাস্থ্য সম্মত এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সন্দেহ টা এখানেই থেকে যায় যদি পানির উৎস সঠিক না হয় এবং একজনের গ্লাস অপরজনে বহুবার ব্যবহারে রোগ জীবানু ছড়ানোর সম্ভাবনা থেকে থাকে। তবে এসব উপদান বাড়িতে নিয়ে তৈরী করে পান করাই ভালো।