বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাশ হয়েছে ২০০০ সালে,যা একাধিক বার সংশোধিত হলেও ২০২৫ সালে যে সংশোধনী করা হয়েছে তাতে বিবাহের প্রলোভনে সংঘটিত যৌনকর্মকে আলাদা অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে ৭(সাত) বছরের শাস্তির বিধান করা হয়েছে এবং এজাতীয় অপরাধে শুধু পুরুষকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে যা যৌক্তিক কি না বা ন্যায় বিচারের মানদণ্ডে গ্রহনযোগ্য কি না তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি অত্র লেখনিতে।
শুরুতেই আমাদের জানা দরকার বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে ধর্ষন বলতে কী বুঝানো হয়েছে।বাংলাদদেশে বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২৫(সর্বশেষ সংশোধনী-২০২৫) এবং দণ্ডবিধি-১৮৬০ উভয় আইনেই ধর্ষন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান আছে।নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২(ঙ) ধারায় ধর্ষনের সংজ্ঞা উল্লেখ করা আছে এবং উক্ত ধারায় বলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এর ৯(১) ধারার বিধান সাপেক্ষে দন্ডবিধি-১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় উল্লেখিত ধর্ষনের সংজ্ঞাই ধর্ষনের সংজ্ঞা হিসেবে পরিগনিত হইবে।দন্ডবিধি-১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত ধর্ষনের সংজ্ঞা বিশ্লেষনে পাই যে,পাঁচ ধরনের যৌন সহবাস নারী ধর্ষন হিসেবে গন্য হইবে-১)নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ২)নারীর বিনা সম্মতিতে ৩)নারীর সম্মতিতে কিন্তু সে সম্মতি যখন মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় ৪)নারীর সম্মতিতে কিন্তু এই বিশ্বাসে সম্মতি দিয়েছে যে পুরুষ লোকটি তার আইনগতভাবে বিবাহিত স্বামী অথচ পুরুষ লোকটি জানে যে সে ঐ নারীর আইনত স্বামী নন
৫)নারীর সম্মতি সহ বা ব্যাতীত যখন নারীর বয়স চৌদ্দ বছরের কম।যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারার ব্যাখায় উক্ত বয়স বিষয়ে এভাবে উল্লেখ আছে যে, ষোল বছরের কম বয়সী যেকোন নারী বা শিশুর সম্মতি থাকুক বা না থাকুক তার সাথে কৃত যৌন সহবাস ধর্ষন হিসেবে গন্য হইবে এবং ষোল বছরের বেশী বয়সী যেকোন নারীর সম্মতি ব্যাতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রতারনার মাধ্যমে আদায়কৃত সম্মতিতে কৃত যৌন সহবাস ধর্ষন হিসেবে গন্য হইবে।
এখানে উল্লেখ্য যে,প্রতারনার মাধ্যমে সম্মতি আদায়ের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখা করা নেই বিধায় ধর্ষণের সংজ্ঞার এই অংশকে বিভিন্নভাবে ব্যাখা বা বিশ্লেষণ করার সুযোগ আছে বিধায় এতদিন যাবৎ বিবাহের প্রলোভনে বা আশ্বাসে ষোল বছরের উর্ধ্বে বা প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর স্বেচ্ছায় সম্মতিতে অন্য পুরুষের সাথে সংঘটিত যৌনকর্মকেও ধর্ষন হিসেবে উল্লেখ করে মামলা করার সুযোগ ছিল এবং এজাতীয় মামলা অহরহ দায়ের হত।যদিও মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে বিবাহের প্রলোভনে প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর সম্মতিতে অন্য পুরুষের সাথে স্থাপিত যৌন সম্পর্ক ধর্ষনের আওতাভুক্ত নয় মর্মে উল্লেখ রয়েছে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-২০২৫ এর ৯(খ) ধারায় বিবাহের প্রলোভনে সংঘটিত যৌনকর্মকে আলাদা অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যা দেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট,বাস্তবতা এবং নৈতিকতার মানদণ্ডে উপযোগী এবং যৌক্তিক কিন্তু উক্ত অপরাধে শুধুমাত্র পুরুষ পার্টনারকে অপরাধী বা দায়ী হিসেবে বিবেচনা করার বিধান আছে যা অযৌক্তিক,একপেশে এবং পুরুষদের সাংবিধানিক অধিকার পরিপন্থি যার মাধ্যমে পুরুষ হয়রানী বাড়বে এবং এক শ্রেনীর নারীরা এর অপব্যবহার করার সুযোগ পাবে যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে।উল্লেখিত ধারা বিশ্লেষণে বুঝা যায় যে,কোন নারী পুরুষের মধ্যে আস্থাভাজন সম্পর্ক থাকা অবস্থায় বিবাহের প্রলোভনে যৌনকর্ম করলে এবং পরবর্তিতে বিবাহ না করলে বা করতে অস্বীকমতি জানালে তা অপরাধ হিসেবে গন্য হইবে।এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যেহেতু ধর্ষণের সংজ্ঞায় উল্লখ আছে যে,ষোল বছরের কম বয়সী নারীর সম্মতি থাকুক বা না থাকুক তা ধর্ষন হবে সেক্ষেত্রে সংশোধিত ধারাটি ষোল বছরের অধিক বয়সের নারীদের সাথে বিবাহের প্রলোভনে কৃত যৌনকর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।প্রেমের সম্পর্ক থেকে কিংবা অন্য কোন সম্পর্কে জড়িয়ে কোন নারী এবং পুরুষ স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক করার পর যদি সম্পর্ক ভেঙে যায় বা বিবাহ করতে না চায় তখন পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুযোগ করে দিয়েছে।অথচ এজাতীয় অপরাধ সংঘটনের সময় নারীর ও সম্মতি ছিল বিধায় নারীকেও অপরাধী হিসেবে পরিগনিত করে কিংবা শাস্তির আওতায় আনার বিধান যুক্ত থাকলে অসামাজিক কার্যক্রম কমতো এবং হয়রানীর উদ্দেশ্যে অপব্যবহার কম হতো।পাশাপাশি নারী নিজে যদি তৎপরবর্তিতে বিবাহ করতে অস্বীকৃতি জানায় সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ এই ধারার নেই যার ফলে এজাতীয় ঘটনা থেকে পুরুষের প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। যা থেকে বুঝা যায় সংশোধিত ধারাটি নারী-পুরুষের অসামাজিক কাজে নারীকে দায়মুক্তি দিবে,পুরুষের বিরুদ্ধে হয়রানি মূলক মামলা বা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত মামলা দায়েরের সুযোগ তৈরি করবে এবং নারী কর্তৃক পুরুষকে প্রতারিত করার পথ সৃষ্টি করতে পারে বিধায় অধিকতর বিচার বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে সংশ্লিষ্ট ধারাটি যৌক্তিকভাবে সংশোধন করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ রইল।
লেখক:
এডভোকেট মো:কাওসার হোসাইন,
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবি এবং আইনগ্রন্থপ্রনেতা।