নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে আইন সংশোধনের উদ্যোগ জাতীয় নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্প্রতি, আইনজীবী আসিফ নজরুল স্যার সংবাদ সম্মেলনে যে পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে, এ প্রক্রিয়ায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের উপর আরও গভীরভাবে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এই প্রস্তাবিত আইন পরিবর্তনগুলো দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে হলেও, তার মধ্যে কিছু বাস্তবিক সমস্যা এবং বৈধতা রয়েছে যেগুলি বিচারিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার রক্ষায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
**১. বিচারিক প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানো দরকার, তবে অবিচার রোধের গুরুত্বও অপরিহার্য**
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আসিফ নজরুল স্যারের পরিকল্পনার উদ্দেশ্য অত্যন্ত মানবিক এবং সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ন। তবে, আমরা যে সময়ে দ্রুত বিচার এবং তদন্তের কথা বলছি, সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন দ্রুততার সাথে বিচার নিশ্চিত করা দরকার, অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন পর্যাপ্ত প্রমাণ এবং সঠিক তদন্ত নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনমনে ক্ষোভের প্রেক্ষিতে অথবা অতি দ্রুততার জন্য এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হবে না, যা পরবর্তীতে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা যে “অবিচার” শব্দটির দিকে নজর রাখি, তা যেন বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
**২. ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার প্রস্তাব এবং তার বাস্তবিক অসুবিধা**
আইন সংশোধনে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করার যে বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবিকভাবে অসম্ভব। একটি মনগড়া তদন্ত রিপোর্ট তৈরি হতে পারে, যেখানে হয়তো নির্দোষ ব্যক্তিও শিকার হতে পারে। এর পাশাপাশি, ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তদন্ত শেষ করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের বিচার ব্যবস্থায়, একটি সম্পূর্ণ তদন্তের জন্য আরো সময় এবং মনোযোগ প্রয়োজন, বিশেষত যখন অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর এবং সংবেদনশীল।
**৩. ৯০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব নয়**
সামাজিক দুর্নীতি রোধ ও দ্রুত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে, বিচার প্রক্রিয়া ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তা বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হবে না। অত্যন্ত গুরুতর অপরাধে যেমন ধর্ষণ বা শিশু নির্যাতন, সেখানে যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া, সাক্ষী এবং প্রমাণ সংগ্রহের জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়। বিচার প্রক্রিয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া গেলে এর ফলে আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে, যা মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করবে। ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার পরিবর্তে, সময়সীমা কিছুটা নমনীয় রাখা উচিত, যাতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্বচ্ছ এবং সঠিক বিচার নিশ্চিত করা যায়।
**৪. ডিএনএ রিপোর্টের গুরুত্ব**
ধর্ষণ বা শিশু নির্যাতন মামলার প্রমাণ হিসেবে ডিএনএ রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে গিয়ে এর গুরুত্বকে অবহেলা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ডিএনএ রিপোর্টের যথাযথ বিশ্লেষণ ছাড়া, মামলার সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন এবং অনেক সময় এটি মামলার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
**৫. অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনের অধিকার**
আইনের অধীনে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত জামিন পেতে পারেন। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে, অভিযুক্তের অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না। তবে, জামিনের শর্তাবলী নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদালতকে অধিক ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে, যাতে বিচার প্রক্রিয়া বিরতি না হয় এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত ও প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়।
**৬. দোষী ব্যক্তির কঠিনতম শাস্তি**
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন মামলা পরিচালনায় দোষী ব্যক্তির কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করা। তবে, এই শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য বিচারিক প্রক্রিয়া অবশ্যই সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং যথাযথ হতে হবে। তাতে কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং সমাজে অপরাধীদের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা যাবে।
সংক্ষেপে, আইন সংশোধনের উদ্যোগগুলি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো, কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলির বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধা এবং সতর্কতা রয়েছে। দ্রুত বিচার এবং কার্যকর আইন প্রয়োগের জন্য সময়সীমা এবং প্রক্রিয়া সংশোধন করা হলেও, তা যেন আইনগত সঠিকতা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হয়। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা যা দ্রুত, সুবিবেচিত এবং ন্যায়সঙ্গত হয়।
**লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট**