চিকিৎসা ভাতা ও গৃহ ঋণ বাড়ানোসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিশেষ ৯টি সুবিধা চেয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত ২১টি প্রস্তাবের মধ্যে ৯ প্রস্তাবেই তাদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ডিসি সম্মেলনের শেষদিন এ প্রস্তাবগুলো নিয়ে কার্য-অধিবেশন হবে। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন শুরু হয় গত রোববার।
সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রদেয় গৃহনির্মাণ ঋণ-সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন ও ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ময়মনসিংহের ডিসি। প্রস্তাবের পক্ষে তার যুক্তি—১. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গৃহনির্মাণ বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য গ্রেড ভেদে ৩০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত রাষ্ট্র মালিকানাধীন তপশিলি ব্যাংক বা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স করপোরেশনের মাধ্যমে ঋণ পেয়ে থাকেন।
২. ঋণ গ্রহণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঋণ গ্রহণের পর চাকরির বয়স কম হলে তাকে অধিক হারে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়, ফলে তার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। ৩. ঋণের কিস্তি কর্তন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রদেয় সরকারি বাড়িভাড়া ভাতা থেকে বেশি হওয়ায় ওই কর্মকর্তার জীবিকা নির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। ৪. ঋণ গ্রহণকারীর কিস্তির টাকা তাকে সরকার প্রদেয় মাসিক বাড়িভাড়া থেকে কর্তন করা যেতে পারে। এভাবে কর্তনকৃত টাকা দিয়ে সম্পূর্ণ ঋণ ও মুনাফা পরিশোধ না হলে পিআরএলের সময় গ্র্যাচুইটি বা পেনশন থেকে কর্তন করা। ৫. বর্তমানে গৃহ ঋণ বাবদ সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়; যা মানসম্মত গৃহনির্মাণ বা ফ্ল্যাট ক্রয় করার ক্ষেত্রে খুবই কম। সুতরাং গৃহনির্মাণ-সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহ ঋণ প্রদান-সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করা যেতে পারে।
সরকারি চাকরিজীবীদের সন্তানের জন্য প্রদেয় ‘শিক্ষা-সহায়ক ভাতা’ দুই হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাবও করেছেন ময়মনসিংহের ডিসি। তার যুক্তি হচ্ছে, সব সরকারি চাকরিজীবীর সন্তান প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে এবং অনধিক দুই সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা পরিমাণ শিক্ষা-সহায়ক ভাতা পেয়ে থাকেন। এ ভাতা বর্তমান সময়ে খুবই কম। ফলে এ ভাতা বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
সরকারি চাকরিজীবীদের চিকিৎসা ভাতা আরও বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাবও দিয়েছেন ময়মনসিংহের ডিসি। তার ভাষ্য, চিকিৎসা ব্যয় ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে প্রদেয় ভাতা খুবই অপ্রতুল। সুতরাং চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ ভাতাও সমন্বয় করা প্রয়োজন।
প্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য রেশন সুবিধা চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার এবং গোপালগঞ্জ ও জয়পুরহাটের ডিসি। তাদের যুক্তি—১. প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন বাহিনীর মতো দুর্যোগসহ যে কোনো পরিস্থিতিতে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করেন। ২. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতো বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন সুবিধা পেলেও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ সুবিধা নেই। ৩. রেশন সুবিধা প্রদান করা হলে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা বাড়বে এবং তারা অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবেন।
অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন সাতক্ষীরার ডিসি। তিনি প্রস্তাবের পক্ষে বলেছেন—১. একজন সরকারি কর্মচারী তার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে সর্বোচ্চ মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা কার্যভারভাতা পান, যা খুবই কম। ২. যেহেতু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পালন করেন, সেহেতু দায়িত্বশীলতা ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে সরকারি কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা ও প্রণোদনা বৃদ্ধিতে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ভাতা মূল বেতনের ৩০ শতাংশ করার পক্ষেও তিনি মত দেন।
মাঠ প্রশাসনে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ভাতা চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন গোপালগঞ্জের ডিসি। প্রস্তাবের পক্ষে তার যুক্তি হলো—১. বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অফিসের অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। যার মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিনা হয়রানিতে জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। ২. বর্তমান সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইমেইল ইত্যাদির মাধ্যমে অফিসিয়াল যে কোনো তথ্য তাৎক্ষণিক সংগ্রহপূর্বক তথ্য আদান-প্রদান করার ফলে খরচ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। ৩. নাগরিক সেবা দ্রুত সম্পাদন করতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ইন্টারনেট সুবিধা বিদ্যমান আছে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবার পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা সার্বক্ষণিক সচল থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই মাঠ প্রশাসনে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ভাতা চালু করা আবশ্যক।
এ ছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে পার্বত্য জেলাগুলোয় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক পাহাড়ি ভাতা যৌক্তিক হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিসিদের ভাষ্য, ১. পার্বত্য জেলাগুলোর দুর্গম এলাকার ঝুঁকি বিবেচনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাহাড়ি ভাতা হিসেবে প্রদান করা হলে তারা পার্বত্য এলাকার পদায়িত হয়ে চাকরি করতে অনুপ্রাণিত হবেন। ২. পার্বত্য অঞ্চলের শূন্য পদগুলোয় দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং ৩. কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির প্রবণতা কমবে।