বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে এখন নতুন এক প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে—প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য ব্যক্তিগত শেমিং বা অপমানজনক প্রচারণা। বিশেষত, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক বিস্তারের ফলে এই প্রবণতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যুক্তি-তর্কের জায়গা যখন ফুরিয়ে যায়, তখন ব্যক্তিগত আক্রমণই হয়ে ওঠে প্রধান অস্ত্র।
সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনার শিকার হয়েছেন ফারজানা (প্রকৃত নাম গোপন রাখা হলো), যিনি দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে আসছেন। তার ছবি বিকৃত করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, উদ্দেশ্য একটাই—তার মানসিক দৃঢ়তা দুর্বল করা, পরিবারকে চাপে রাখা, এবং তাকে জনসমক্ষে হেয় করা। এসব ঘটনার পেছনে যারা থাকেন, তাদের মূল লক্ষ্য কখনোই ব্যক্তিকে শুধুমাত্র আঘাত করা নয়; বরং তারা একটি বার্তা দিতে চান—“এই পথে এগোলে তোমারও একই পরিণতি হতে পারে।”
### **শেমিং-এর আসল লক্ষ্য কী?**
এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য হলো, যেকোনো সোচ্চার কণ্ঠস্বরকে চুপ করিয়ে দেওয়া। এটি এক ধরনের মানসিক নিপীড়ন, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সমাজের চোখে একঘরে করার চেষ্টা চলে। আমাদের সমাজে নারীদের বিরুদ্ধে এই কৌশল বিশেষভাবে বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ নারীর সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদাকে নষ্ট করার চেষ্টা করলেই তাকে সহজে বিচ্ছিন্ন করা যাবে—এই ধারণা থেকে এসব আক্রমণ পরিচালিত হয়।
শেমিং-এর পেছনে বসে থাকা ব্যক্তিরা জানে, একজন মানুষ তার আত্মসম্মানবোধ হারালে, তার লড়াই করার শক্তি কমে যায়। তাই এই আক্রমণ শুধু ফারজানার মতো একজন কর্মীকে থামানোর জন্য নয়, বরং যারা ভবিষ্যতে তার মতো হয়ে উঠতে পারে, তাদের জন্যও একটি বার্তা—“এই পথে গেলে, তুমিও এই পরিস্থিতির শিকার হবে।”
### **শেমিং থেকে রেসিলিয়েন্স: কীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়?**
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো **shame resilience** বা অপমান সহ্য করার ক্ষমতা গড়ে তোলা। এটি সহজ নয়, তবে সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য চারটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে—
১. **শেম বা লজ্জার অনুভূতিটা বুঝতে পারা:** অনেক সময় অপমানজনক প্রচারণার শিকার হলে আমরা রাগ, ক্ষোভ, হতাশা অনুভব করি, কিন্তু আসল অনুভূতি লুকিয়ে থাকে লজ্জার আড়ালে। লজ্জার কারণ বুঝতে পারলে তা মোকাবিলা করাও সহজ হয়।
২. **ঠিক কী কারণে লজ্জিত বোধ করছি তা চিহ্নিত করা:** নিজের মধ্যে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, অপমানের উৎস কোথায়? তা না হলে প্রতিক্রিয়া দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।
৩. **গল্পটাকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করা:** আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিজেই ব্যাখ্যা করে দিতে পারেন যে এই অপপ্রচার কেন চালানো হচ্ছে, তাহলে সেই প্রচারের ক্ষমতা কমে যায়।
৪. **খোলাখুলি কথা বলা:** যারা অপমানজনক প্রচারের শিকার হন, তাদের উচিত নিজের অবস্থান পরিস্কার করা এবং সত্যকে সামনে নিয়ে আসা। যারা চুপ থাকেন, তারা মূলত প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য পূরণ করতেই সাহায্য করেন।
### **এবার কী করা উচিত?**
শেমিং বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো **ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।** এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে—
– **সামাজিকভাবে সংহতি প্রকাশের মাধ্যমে:** আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ফেলে দিলে অপমানকারীরা আরও শক্তি পাবে। তাই যারা এসব ঘটনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চান, তাদের একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে।
– **সোশ্যাল মিডিয়ায় পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরি করে:** মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে সত্য প্রচার করতে হবে এবং অপপ্রচারকারীদের এক্সপোজ করতে হবে।
– **আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ:** সাইবার ক্রাইম এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এ ধরনের অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে না যায়।
### **শেষ কথা**
শেমিং-এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার এই সংস্কৃতি একটি ভয়ংকর জায়গায় গিয়েছে। এটি শুধু ফারজানার মতো ব্যক্তিদের ক্ষতি করছে না, বরং এটি পুরো সমাজকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ শুধু ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; এটি হতে হবে সামাজিক, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে।
আজ যাকে টার্গেট করা হয়েছে, কাল সে আমি বা আপনি হতে পারি। তাই এখনই সময় একসঙ্গে দাঁড়ানোর, শেমিং-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার, এবং সত্যের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ার।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
কলামিষ্ট, সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান – জীবনানন্দ দাশ গবেষণা কেন্দ্র