একটি প্রকল্পে চাচা সভাপতি, ভাতিজা সদস্য সচিব!
কৃষকদের বাদ দিয়ে প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত ফসলরক্ষা বাঁধ মেরামতের লক্ষ্যে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে ব্যপক অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকেলে তাহিরপুর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা এবং কাবিটা স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. আবুল হাসেম স্বাক্ষরিত ৩০ পিআইসির খসড়া তালিকা অনুমোদন হওয়ার পর পিআইসি গঠনে ব্যপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেন কৃষকরা। স্থানীয় কৃষকদের পিআইসিতে যুক্ত না করে বহিরাগত অযোগ্য, অদক্ষ এবং ছাত্র ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে হাওর পাড়ের কৃষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে, অনুমোদন হওয়া খসড়া তালিকা বাতিল করে নতুন করে কৃষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করার দাবি স্থানীয় কৃষকদের।
অনুমোদন হওয়া খসড়া তালিকায় দেখা যায়, প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও কৃষক নয় এমন ব্যক্তি এবং ছাত্রদের নিয়ে পিআইসি গঠন করা হয়েছে। সূত্র জানায়, উপজেলার এক প্রভাবশালী নেতার সুপারিশে মহালিয়া হাওর উপ-প্রকল্পের ২৫ নং পিআইসি কমিটিতে শ্রীপুর (দ:) ইউনিয়ন যুবদলের সাধারন সম্পাদক সাইকুল ইসলামকে সভাপতি এবং একই ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি শাহ আলমকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। অনুমোদন হওয়া এই পিআইসির সভাপতি সাইকুল ইসলামের মহালিয়া হাওরে কিছু ফসলি জমি থাকলেও মহালিয়া হাওরে এই পিআইসির সদস্য সচিব ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি শাহ আলমের এক ইঞ্চি জমিও নেই। তারা দুজনই রাজনীতির পাশাপাশি জড়িত আছেন ব্যবসার সাথে।
এদিকে মহালিয়া হাওর উপ-প্রকল্পের ২৮ নং পিআইসি কমিটিতে শ্রীপুর (দ:) ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি খসরুল ইসলামকে সভাপতি এবং তার ভাতিজা বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দিগেন্দ্র বর্মণ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। খসরুল ইসলাম সুলেমানপুর বাজারের একজন ব্যবসায়ী ও সুলেমানপুর বাজার ফেরিঘাটের ইজারাদার বলে জানা যায়।
অন্যদিকে মহালিয়া হাওর উপ-প্রকল্পের ২৬ নংপিআইসির সভাপতি করা হয়েছে শ্রীপুর (দঃ) ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবুল মিয়ার ঘনিষ্টজন মাফিক মিয়া এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে ইউনিয়ন যুবদলের প্রচার সম্পাদক মনির মিয়াকে। এদিকে উপজেলার শনির হাওরের তীরবর্তী মাড়ালা গ্রামের বাসিন্দা রুবেল আহমেদকে সভাপতি ও সাইদুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে ২৭ নং পিআইসির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মহালিয়া হাওর উপ-প্রকল্পের অপর একটি কমিটিতে (২৪ নং) সদস্য করা হয়েছে বিএনপি নেতা দুলাল মিয়াকে। দুলাল মিয়া গতবছর এই হাওরের একটি প্রকল্পের সদস্য সচিব ছিলেন, তবে সেই সময় তার বিরুদ্ধে বাঁধ নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও গাফিলতির ব্যপক অভিযোগ উঠেছিল।
অভিযোগ আছে, হাওরের প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে শুধু মহালিয়া হাওর নয় উপজেলার শনি ও মাতিয়ান হাওরেও বেশ কয়েকটি পিআইসি কমিটি তুলে দেওয়া হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী অকৃষকের হাতে। ফলে কৃষকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। তবে অযোগ্যদের পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিব এর দায়িত্ব দেওয়ায় ফুঁসে উঠছেন হাওরের কৃষকরা।
মহালিয়া হাওরের কয়েকজন কৃষক জানান, প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে এই হাওরে পিআইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যাবসায়ী ও একজন ছাত্রকে। তাছাড়া একটি প্রকল্পে চাচা সভাপতি, ভাতিজা দিগেন্দ্র বর্মণ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কিভাবে তারা পিআইসি কমিটি পেল তা এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
মাটিয়ান হাওরের পারের কৃষক লিমন মিয়া বলেন, প্রতি বছর নিতিমালা অনুযায়ী গনশুনানীর মাধ্যমে পিআইসি কমিটি গঠন করা হয়। এই বছর গনশুনানী হয়েছে কিন্তু গনশুনানী করার পর প্রকৃত কৃষককে বাদ দিয়ে পিআইসি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাহা নিতীমালা বহির্ভূত। আমরা প্রকৃত কৃষক যারা আছি তারা এই অনিয়মের তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি আমরা হাওরবাসী এই অনিয়মতান্ত্রীক প্রকাশিত কমিটি বাতিলের দাবি জানাই।
এবিষয়ে তাহিরপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল হাসেমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খসড়া তালিকা অনুমোদন করা হয়েছে, বিষয়টিবখতিয়ে দেখবো।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের প্রলয়ংকরী আগাম বন্যায় সুনামগঞ্জের বোরো ধানের সম্পূর্ণ ফলন নষ্ট হওয়ার পর অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সংশোধন হয় ‘কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা’। সংশোধিত নীতিমালায় বাঁধের কাজ শুরু ও শেষের সময় বেঁধে দেওয়া হলেও বিলম্ব হচ্ছে প্রতি বছরই। আর বিলম্বের অজুহাত হিসেবে থাকে হাওরের পানি ধীরে নামার বিষয়। সেই ধারাবাহিকতা এবারও বজায় রয়েছে। সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজের জন্য পাঁচ থেকে সাত সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। কাজের আর্থিক মূল্যের হিসাবে প্রতি ২৫ লাখ টাকার একটি করে স্কিম প্রস্তুত করে তার জন্য বাঁধের পার্শ্ববর্তী কৃষি জমির মালিকদের নিয়ে একটি করে পিআইসি গঠন করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর ৩০ নভেম্বরের আগে জরিপ শেষ করে সব পিআইসি গঠন করতে হবে। তারপর ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সবকটি বাঁধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা শেষ করার কথা উল্লেখ রয়েছে।