কখনো কখনো মনে হয়, আমরা যেন এক দ্রুতগামী সময়ের অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আশেপাশে অসংখ্য মানুষ থাকলেও, কেউ আর নবকুমারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় না। সে শুধু গল্পের চরিত্র হয়ে রয়ে গেছে – বাস্তবে তার দেখা পাওয়া দুষ্কর।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবী চৌধুরানী”-র সেই নবকুমার, যে নিজের প্রাণের পরোয়া না করে অন্যের উপকারে ছুটে গিয়েছিল, আজকের সমাজে যেন নেই বললেই চলে। হয়তো আজও কেউ কেউ আছেন, যারা নিরবে, নিঃস্বার্থে পরোপকারের কাজ করে চলেছেন। কিন্তু আমরা তাদের দেখে হাসাহাসি করি, পরিহাসের ছলে তাদের আত্মত্যাগের ফায়দা নিই।
সময়ের গতিতে মানুষ হয়ে পড়েছে আত্মকেন্দ্রিক। কেউ যেন আর অন্যের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করতে চায় না। অনেক সময় ভাবি, “উত্তম হইয়া আমি পাইবটা কী?” এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলি নিজেদের মানবিকতা, পরোপকারের সহজাত প্রবৃত্তি। অথচ নবকুমারের মতো মানুষদের কারণেই সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বিখ্যাত লাইন আজও কানে বাজে –
**“তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”**
সমাজের অনেকেই হয়তো ভয়ে, লজ্জায় বা হতাশায় ভালো কাজ করতে পিছপা হন। কিন্তু যাদের মনে নবকুমারের “ঝাঁপিয়ে পড়ার রোগ” আছে, তারা শত বাঁধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এগিয়ে যান। তাদের জন্য টিটকিরি, ব্যঙ্গ, এমনকি আত্মত্যাগও যেন কোনো ব্যাপার নয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় – নবকুমার কোথায়?
সময়ের এই অবিরাম ছুটে চলায় কি সত্যিই নবকুমার হারিয়ে গেছেন? নাকি তিনি লুকিয়ে আছেন আমাদের মাঝেই, শুধু সময়ের অভাবে আমরা তার খোঁজ নিতে পারছি না?
**সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ডাক**
আজকের সমাজে প্রকৃত ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন নবকুমারের মতো চরিত্র। যারা সমাজের প্রতি অবিচার, বৈষম্য এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেন। নবকুমারেরা চিরকালই সংখ্যালঘু, কিন্তু তাদের কারণেই সমাজে ন্যায়ের আলো ছড়িয়ে পড়ে।
**আলো জ্বালানোর প্রত্যয়**
আমরা যদি সত্যিই চাই সমাজে পরিবর্তন আনতে, তাহলে আমাদের প্রত্যেককেই একটু একটু করে নবকুমার হতে হবে। হয়তো একা একা পুরো সমাজ বদলে ফেলা সম্ভব নয়, কিন্তু নিজের চারপাশের মানুষদের একটু সাহায্য করলেই সেই আগুনের আলো দূরে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
আজকের এই লেখার শেষে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ পংক্তির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই –
**“মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।”**
এ পংক্তির আবেদন চিরকালীন, চিরন্তন। আমরা যদি সত্যিই মানুষ হয়ে উঠতে চাই, তবে আমাদের প্রত্যেকেরই নবকুমারের পথে হাঁটতে হবে – একা হলেও।
**ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম**
*কলামিস্ট, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ*