কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ জনকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) রাত থেকে মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) সকাল পর্যন্ত চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে তাদের আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে জুতার মালা পরানোর পর মুক্তিযোদ্ধাকে টানাহেঁচড়া করা প্রধান দুই অভিযুক্ত (বহিষ্কৃত জামায়াত সমর্থক) এখনও আটক হয়নি।
মঙ্গলবার বিকাল ৪টার দিকে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিং করে চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ টি এম আক্তার উজ জামান আটকের বিষয়টি জানান। এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। তবে মামলা করার জন্য এজাহার নিয়ে আসার সময় দুর্বৃত্তরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলে ওই মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করেছেন।
আটক পাঁচ জন হলেন চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা গ্রামের ইসমাইল হোসেন মজুমদার (৪৩), মো. জামাল উদ্দিন মজুমদার (৫৮), ইলিয়াছ ভূঁইয়া (৫৮), স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও পাশের নাঙ্গলকোট উপজেলার রায়কোট গ্রামের আবুল কালাম আজাদ (৪৮) এবং চাঁদপুর সদরের মইশাদী গ্রামের জাকির হোসেনের ছেলে ইমতিয়াজ আবদুল্লাহ সাজ্জাদ (১৯)। ইমতিয়াজ প্রধান অভিযুক্ত আবুল হাশেমের ভাগনে। বিকালে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ব্রিফিংয়ে ওসি আক্তার উজ জামান বলেন, ‘গত রবিবার দুপুরে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাটি জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশ। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে লাঞ্ছিত করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হয়। ভিডিও ফুটেজে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আটক করার জন্য অভিযান চালানো হয়। সোমবার রাতভর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে পাঁচ জনকে আটক করা হয়।’
আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ওসি বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইয়ের সঙ্গে একই এলাকার আবুল হাশেমের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। ২০০৮ সালে কুলিয়ারা উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবদুল হাই বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে হাশেমের বড় ভাই আবদুল হালিমকে মারধর করাসহ অপমান করেছিলেন। ভাইয়ের অপমানকে কেন্দ্র করে হাশেম ওই দিন পাতড্ডা বাজার থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইকে ধরে কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে আসেন। তখন মাঠে এলাকার লোকজন জড়ো হলে তাদের কাছে হাশেম ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার কী বিচার করা যায়, জিজ্ঞাসা করেন। তখন সেখানে থাকা নয়ন নামের একজন ওই মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রামের সবার কাছে মাফ চাইতে বলেন এবং এলাকা থেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই হঠাৎ হাশেমের সামনে পড়ায় ওই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।’
গত রবিবার দুপুরে চৌদ্দগ্রামের বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইকে (৭৮) জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে রাতে এ ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় কোনও মামলা হয়নি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়
ওসি এ টি এম আক্তার উজ জামান বলেন, ‘আটক ব্যক্তিদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তী সময়ে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা এ ঘটনায় মামলা করতে চেয়েছেন। তিনি মামলা করলে আসামিদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। প্রধান অভিযুক্ত কুলিয়ারা গ্রামের আবুল হাশেম, অহিদুর রহমানসহ ঘটনায় জড়িত অন্য ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।’
এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিতের ঘটনায় মামলার জন্য প্রস্তুত করা এজাহারের কপি ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ও তার স্বজনেরা। বিকাল ৪টার দিকে ফেনী জেলা আদালতের ফটকের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানান আবদুল হাই।
মুক্তিযোদ্ধার ছেলে যুবলীগ নেতা গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার বাবাকে সোমবার রাতে হাসপাতাল থেকে ফেনীর একটি বাসায় নিয়ে এসেছি। তবে বাবা এখনও সুস্থ হননি। পুলিশ ও প্রশাসন আমাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছে মামলা করার জন্য। এ ছাড়া সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ায় আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। এজন্য ফেনী আদালতের একজন আইনজীবীর মাধ্যমে মামলার এজাহার তৈরি করেছিলাম। আরজিতে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করেছি আমরা। আমার বাবা নিজেই মামলার বাদী।’
গোলাম মোস্তফার দাবি, তিনি তার বাবাকে আদালতে নিয়ে আসেন এজাহারে স্বাক্ষর করানোর জন্য। বিকাল ৪টার দিকে তারা আদালতের ফটক থেকে বের হওয়া মাত্রই ২০-৩০ জন তাদের ঘিরে ফেলেন এবং এজাহারের কপি ছিনিয়ে নেন।
তিনি বলেন, ‘আর কিছুক্ষণ থাকলেই আমাদের ওপর বড় ধরনের হামলা হতে পারত। দ্রুত বাবাকে নিয়ে ফেনী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রবেশ করে নিজেদের রক্ষা করেছি। এত কিছু যেহেতু হয়েছে, আমরা অবশ্যই মামলা করব। আমরা আবার এজাহার তৈরি করছি। পুলিশের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। পুলিশ বলেছে, সরাসরি যেতে সমস্যা হলে এজাহারের কপি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে।’