তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
দেশে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ৭টি ও জাতীয় উদ্যান ১০টি এর মধ্যে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান অন্যতম। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন মানচিত্রে এক হাজার ২৫০ হেক্টর থাকলেও বাস্তবে ঠিক কতটুকু বনভূমি, তা সুস্পষ্টভাবে জানে না খোদ বন কর্তৃপক্ষ।
দীর্ঘদিন ধরে আয়তন পরিমাপ না হওয়ায় বনের চারপাশের জমি যে যেমন ভাবে সম্ভব হয়েছে দখল করছেন। দখলকৃত জায়গায় কেউ করছেন চা বাগান, কেউবা লেবু-আনারসের বাগান কেউবা গড়ে তুলেছে বিলাসবহুল রিসোর্ট। তবে অনেক পরে হলেও দখলে থাকা লাউয়াছড়া বনের জমি উদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, অনেকবার চেষ্টা করেও সীমানা নির্ধারণ (ডিমার্গেশন) করা বা দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। দখলদারদের প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় বিগত দেড় দশকে সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে অনেক পরে হলেও দখলে থাকা লাউয়াছড়া বনের জমি উদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামের চা বাগানের দখলে থাকা প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধার করা হয়।
সর্বশেষ ৩রা নভেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে কমলগঞ্জ উপজেলার ৫ নং কমলগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য বদরুল আলম জেনার এর দখলে থাকা প্রায় চার একর বনভূমি উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। উদ্ধার করা বনভূমিতে বন্যপ্রাণীদের খাবার উপযুক্ত ফলজ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে।
বন বিভাগ যে চার একর বনভূমি উদ্ধার করেছে, সেই জমিতে লেবু চাষ করেন শাহ্ আলম নামের এক ব্যক্তি। তিনি জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪ নং সিন্দুরখান ইউনিয়নের বাসিন্দা।
শাহ্ আলম জানান, বদরুল আলম জেনার এর কাছ থেকে ওই জমি পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিয়ে এখানে লেবু চাষ করছেন। অগ্রিম হিসেবে ২ বছরের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা কিস্তি অনুযায়ী পরিশোধ করার কথা ছিল।
জানা যায়, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া বনটিকে ১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করা হয়। ‘রেইন ফরেস্ট’ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত। উল্লুক ছাড়াও এ বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু। জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণার আগে থেকেই বনটিতে দখলের থাবা বসিয়েছেন এর আশপাশের কিছু বাসিন্দা। নিজেদের জমির সঙ্গে বনের ভূমি দখলে নিয়ে আশপাশের বাসিন্দারা বাড়িঘর তৈরি ও লেবু-আনারস বাগানের সীমানা বর্ধিত করেছেন।
তবে দখল কার্যক্রম শুরু হয়েছে মূলত ২০০৯ সাল থেকে। সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের সাবেক এমপি মো. আব্দুস শহীদ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ২০০৯ সালে সংসদের চিফ হুইপ মনোনীত হন। সে সময়ে তিনি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমিটরির পাশে কিছু জমি স্বল্পমূল্যে কিনে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে একটি চা-বাগান গড়ে তুলেন। সে সময়েই অভিযোগ ওঠে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আব্দুস শহীদ নিজের কেনা স্বল্প জমির সঙ্গে লাউয়াছড়া উদ্যানের অনেকটা দখল করে সাবারী টি প্ল্যান্টেশনে যুক্ত করেছেন। সেসময় থেকেই বন বিভাগ বারবার বনের জমি পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েও পরিমাপ করতে পারেনি। এরপর থেকেই মূলত লাউয়াছড়া বনভূমি লুটেপুটে খেতে শুরু করেন প্রভাবশালীরা।
বন্যপ্রাণী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ঠিক কতটুকু জমি এখনো প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে, তা অনুমান করা কঠিন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জমি দখলবাজদের চিহ্নিত করার কাজ চলমান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে লাউয়াছড়া বন ডিমার্গেশন (পরিমাপ) করা হবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, মৌলভীবাজারের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, গত ৩রা নভেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে আমরা প্রায় চার একর বনের জমি উদ্ধার করেছি। তবে উদ্ধারের সময় কাউকে পাইনি। কেউ এ জমির মালিকানা দাবি করতেও আসেননি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উদ্ধার করা বনের জায়গাগুলোতে বন্যপ্রাণীর উপযোগী গাছের চারা লাগানো হয়েছে। আগামীতেও এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।