স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ
শারদীয়া দুর্গা পুজোর কয়েকদিন পরই হয় লক্ষ্মীর আরাধনা। লক্ষ্মী ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সুখ, সৌভাগ্য, সৌন্দর্য্য প্রদান করে থাকেন। প্যাঁচা লক্ষ্মীর বাহন এবং তিনি ছয় বিশেষ গুণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আবার শাস্ত্র মতে বিষ্ণুর শক্তির উৎসও লক্ষ্মী। বিষ্ণুর অবতারের সময় তিনিও কখনও সীতা, কখনও রাধা আবার কখনও রুক্মিণী রূপে জন্মগ্রহণ করেন। শরৎ পূর্ণিমায় তাঁর বিশেষ পূজার্চনা করা হয়। একে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বলে।
কোজাগরী শব্দটির উৎপত্তি কো জাগতী অর্থাৎ কে জেগে আছ কথাটি থেকে। বলা হয়, যার সম্পত্তি নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে, আর যার আছে সম্পত্তি সেই সম্পত্তি না হারানোর আশায় জাগে। আর সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পূজার বিশেষ আচার। কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন – কে জেগে আছেন। যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে, লক্ষ্মী তাকে ধন সম্পদ দান করেন ।
গৃহস্থরা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজা করেন। কিন্তু শরৎ পূর্ণিমার কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো ও দীপাবলীর দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজা হয়।পঞ্জিকা অনুযায়ী এই বছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর তিথি শুরু হচ্ছে আগামীকাল বুধবার ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা ৫৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে। আর শেষ হচ্ছে ১৭ অক্টোবর বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে।কোজাগরী লক্ষ্মী পুজা সন্ধ্যা নাগাদ করাই শুভ। এদিন ব্রতপালন, উপবাস ও নিশিযাপন করা হয়। এই রাতে জেগে থাকার বিধান রয়েছে।
ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর আরাধনা বাঙালির এক চিরন্তন প্রথা। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয়ে থাকে। দেবী লক্ষ্মীকে সুখ, সমৃদ্ধি এবং সম্পদের দেবী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। লক্ষ্মীর নিয়মিত আরাধনা করলে জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি থাকে। শুধু তাই নয়, দেবী লক্ষ্মীর আরাধনায় ঘর সর্বদা অর্থ-প্রতিপত্তি-যশে ভরে যায়। আর তাই ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে।নারী পুরুষ উভয়েই এই পূজায় অংশ গ্রহণ করেন।
ধান, চাল, অন্ন, খাদ্যশস্য লক্ষ্মীর প্রতীক। যে ব্যক্তি খাদ্য অপচয় করেন, তাঁদের ওপর লক্ষ্মী ক্ষুব্ধ থাকেন। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গোলাঘর লক্ষ্মীর প্রতীক। আবার ধানক্ষেতের আশপাশে ইঁদুরের বাস। এরা ফসলের ক্ষতি করে। আবার লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচার আহার হল ইঁদুর। এ কারণেই প্যাঁচা লক্ষ্মীর বাহন। উল্লেখ্য, লক্ষ্মী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন।
সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। তাই প্রাচীন কাল থেকে গ্রাম বাংলায় লক্ষ্মী পুজোর সময় ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আল্পনা দেওয়ার প্রথা রয়েছে।এই পূজাতে মূল আল্পনার সঙ্গে বাড়ি জুড়ে আঁকা হয় ধানের ছড়া, মুদ্রা, আর মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের ছবি। এই প্রতীকগুলি পূজার মহত্ত্ব যেমন ব্যাখ্যা করে, তেমনই পূজার আচারের একটা অংশ হয়ে উঠেছে এই বিশেষ ধরনের আলপনা।
এই পুজো লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ বাইরে থেকে বাড়ির ভিতরের অভিমুখে আঁকা হয়। মনে করা হয় লক্ষ্মী সেই পথ অনুসরণ করে গৃহে প্রবেশ করবেন।কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ভোগে অনেক বাড়িতেই জোড়া ইলিশ রাখা হয়। তবে ভোগ হিসাবে খিচুড়ি, লাবড়া থাকা আবশ্যিক। সঙ্গে প্রসাদে ফলমূল তো থাকেই , থাকে নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, ভুশের নাড়ু। এছাড়াও লুচি, পায়েস, মিষ্টির নানা আয়োজন থাকে মা লক্ষ্মীর জন্য। পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে এইদিন মাছের পাঁচ পদের রান্না হয়। আবার পশ্চিমবঙ্গীয় রীতিতে এই দিন পুরো নিরামিষ খাওয়া দাওয়া হয় এবং চালের কোনো রান্না করা হয় না।
করোনা সংক্রমণ পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশের জনগণের জীবনে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির ফলে যে নাভিঃশ্বাস চলছে তা কাটিয়ে উঠুক এই হোক এবারের কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার প্রত্যয়।