ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহর মধ্যে চলমান সংঘাতের পরিধি প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে। গেল মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে হামলা চালিয়েছে ইরান। হামলার পর প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আগামী দিনে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত এক বছর ধরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এর ফলে গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রাণ হারিয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইসরায়েল হেজবুল্লাহকে নিশানা করা শুরু করেছে। হেজবুল্লাহর ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে স্থলপথে লেবাননেও হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ক্রমাগত বেড়ে চলা এই সংঘর্ষ কেন্দ্র করে আরব দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশই স্পষ্টতই বিভক্ত।
প্রায় দুই মাস আগে ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়। ১৯৮০-র দশক থেকে হামাসের নেতা ছিলেন তিনি। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি হামলায় হেজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে।
লেবাননে হেজবুল্লাহর আস্তানাগুলোতে আকাশপথে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। এরই মাঝে হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থলপথেও সামরিক অভিযান শুরু করেছে তারা। ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর ইরানের পক্ষ থেকে সঙ্গে সঙ্গে কোনওরকম সামরিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও পহেলা অক্টোবর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তারা যা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুসলমান প্রধান দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছে ইরান। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করার জন্য আগেই মুসলমান প্রধান দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে ইরান। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জার্মানির মতো দেশগুলো ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধে তাদের সাহায্যও করছে।
ইসরায়েলে সাম্প্রতিক হামলার পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছে নেদারল্যান্ডের রাজনীতিবিদ ও সাংসদদের।
কার পক্ষে আরব দেশগুলো?
আরব বিশ্বের সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো ইসরায়েলি হামলায় হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার প্রকাশ্য নিন্দা না করলেও, তারা লেবাননের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলেছে। এই সংঘর্ষের বিষয়ে কোনও কোনও আরব দেশ যেমন নীরব থেকেছে, কেউ কেউ আবার লেবানন-ইসারেলের সীমান্তে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়েছে। কোন দেশ কী বলছে দেখে নেওয়া যাক।
সৌদি আরব : প্রায় চার মাস আগে রাফাহ শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার পর সৌদি আরব বলেছিল, ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব মেনে নিতে হবে ইসরায়েলকে। সেই সময় সৌদি আরবের এই বিবৃতিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়েছিল।
হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর গত সপ্তাহে সুন্নি নেতৃত্বাধীন সৌদি আরব একটা বিবৃতি জারি করে জানিয়েছিল, লেবাননে যা ঘটছে তা গভীর উদ্বেগের বিষয়। ওই বিবৃতিতে সৌদি আরব লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়েও উল্লেখ করেছিল। তবে সেখানে কোথাও হাসান নাসরাল্লাহর উল্লেখ করেনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সৌদি নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে যে তারা যদি ফিলিস্তিনিদের লড়াই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তা মধ্যপ্রাচ্যে তো বটেই এবং বিশ্বব্যাপীও তাদের ভাবমূর্তির উপর প্রভাব ফেলবে।
মক্কা ও মদিনার জন্য সৌদি আরব মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মুসলিম হজ পালনের জন্য সৌদি আরব যান।
মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন’ বা ওআইসি-র সদর দফতরও সৌদি আরবে অবস্থিত। ওআইসি-কে সৌদি নেতৃত্বাধীন সংগঠন হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের নমনীয় মনোভাব সে দেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত : হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যু এবং তারপরের পরিস্থিতি নিয়ে সুন্নি নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত আরব আমিরাত একেবারে নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। ইউএই-র পাশাপাশি কিন্তু কাতার এবং বাহরাইনও এই প্রসঙ্গে নীরব।
তবে বাহরাইন, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত- এই ছয়টা উপসাগরীয় রাষ্ট্রের সমন্বয়ে তৈরি ‘গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’ বা জিসিসি কিন্তু লেবাননের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটা বিবৃতি জারি করেছে।
লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে জিসিসি। লেবানন সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও অস্ত্র না রাখার কথা বলা হয়েছে বিবৃতিতে। একইসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে লেবাননে যেন অন্য কোনও দেশের প্রশাসন না থাকে।
কাতার : মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের বিষয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কাতার এই সংঘর্ষ বন্ধের পক্ষে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সে দেশের কোনও রকম আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।
মিশর : হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। সেই আলোচনার সময় হাসান নাসরাল্লাহর নাম উল্লেখ না করে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেছিলেন লেবাননের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করার বিরুদ্ধে মিশর।
ইরানের প্রক্সি ও নীতিকে কেন্দ্র করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান মিশরের। তবে ইরানের সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক’ আলাপ চালাতে দেখা যায় তাদের।
হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি জানিয়েছিলেন, সংঘর্ষের কারণে ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি খুবই গুরুতর। মিশরের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, মিশর যে কোনও মূল্যে ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।
জর্ডান : জর্ডানের সঙ্গে আরবের সীমান্ত রয়েছে পশ্চিম তীরে এবং সেখানে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছে। যখন ইসরায়েল গঠন হয়েছিল সেই সময় জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ জর্ডানে পালিয়ে আসে। জর্ডান এই ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে ‘দ্বি রাষ্ট্র’ নীতির পক্ষে কথা বলেছিল।
১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়, যার মাধ্যমে জর্ডান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। গত এপ্রিলে ইরানের ড্রোন ও মিসাইল থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য আমেরিকা ও ব্রিটেনের পাশাপাশি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে দেখা যায় জর্ডানকে।
যদিও এক বিবৃতিতে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, তারা নিজের দেশকে রক্ষা করার অংশ হিসেবে ইরানের ড্রোন ভূপাতিত করেছে, ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য নয়।
তুরস্ক : তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে ১৯৪৯ সাল থেকে। তুরস্কই প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। তবে ২০০২ সাল থেকে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের উত্থান-পতন দেখা গিয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্ক বরাবরই ইসরাইলের বিরোধিতা করে তাদের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখিয়ে এসেছে।
ভারত কার পক্ষে? ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের মধ্যেই ভারত এই দুই দেশে বসবাসরত তাদের নাগরিকদের জন্য পরামর্শমূলক বিবৃতি জারি করেছে। এই সংঘাতের ইস্যুতে ভারত শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে রয়েছে।
প্রসঙ্গত ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভারত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিতে স্পষ্টভাবে কোনও একটা দেশের দিকে ভারতকে ঝুঁকতে দেখা যায়নি।
গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর জন্য আহ্বান জানিয়ে একটা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত অর্থাৎ আইসিজে-র পরামর্শে এই প্রস্তাব আনা হয়েছিল। ১৯৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১২৪টি সদস্য দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।
১৪টি দেশ এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। ভারতসহ ৪৩টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত ব্রিকস-এর মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যারা এই ভোটদান থেকে বিরত ছিল।
পাকিস্তান কাকে সমর্থন করছে? জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিজি, হাঙ্গেরি, আর্জেন্টিনার মতো ১৪টি দেশ। অন্যদিকে, এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও রাশিয়া।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিকে ‘স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে’ জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বা মোড় ঘোরানো মুহূর্ত বলে বর্ণনা করেছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন এই ভোটকে ‘লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের জনগণ ইসরাইলের বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
প্রসঙ্গত, ভারতের কাশ্মীর ও লক্ষ্ণৌওতেও বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে। ২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে বড় আকারের পরিকল্পিত হামলা চালায়। ওই হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়।
এরপরই গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত গাজা ও পশ্চিম তীরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
হেজবুল্লাহর ঠিকানাকে লক্ষ্য করে চালানো ইসরায়েলি হামলাতেও নিহতের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। এই সংঘর্ষের বিস্তৃতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।