কে. এম. সাখাওয়াত হোসেন: নেত্রকোণা মদন উপজেলার নায়েকপুর ইউনিয়নে (ইউপি) ২৭০ জন দুস্থমাতা (ভিজিডি) কার্ডধারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৩০ কেছি চাল বিতরনের সময় বিধি বহির্ভূতভাবে মাসিক ২২০ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা ব্যাংকে সঞ্চয়ের কথা বলে উপকারভোগীদের কাছ থেকে ২২০ টাকা করে তুলেছেন ১৫ মাস। কিন্তু উত্তোলিত টাকা উপকারভোগীদের ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েনি ও তাদের নামে ব্যাংকে হিসাবও নেই এবং ১৫ মাসের জমাকৃত টাকা ফেরতও পাননি তারা।
ভিজিডি কার্ডধারী তাহেরা আক্তার, আমিনা আক্তার, হেলেনা আক্তার, ময়না আক্তার, পারুল আক্তার, দিপা আক্তার, আইরিন, রূপা আক্তার, মমতাজ বেগম তাদের কার্ডগুলো পর্যালোচনা এবং কয়েকজন উপকারভোগীর সাথে কথা বলে ২২০ টাকা করে নেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। বিষয়টি জানাজানি হলে চলতি সপ্তাহে একটি যৌথ ব্যাংক হিসেবে সমুদয় টাকার একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার পায়তারা করছে সংশ্লিষ্টরা।
উপকারভোগীদের কাছ থেকে অবৈধ পন্তায় অর্থ উত্তোলন এবং এই টাকা নিজ বা কারো ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত রাখার সাথে জড়িতরা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয়ের অংশ এমনটা দাবী করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মাইনুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ২০২২ সালে ইউপি নির্বাচনে মো. মোসলেম উদ্দিন ভুঁইয়া নির্বাচিত হন। শপথ গ্রহণের কয়েক মাসের মাথায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বরখাস্ত হন। পরে নায়েকপুর ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. হাদিস মিয়ার নেতৃত্বে সাবেক দুজন ইউপি সচিব হিরণ মিয়া ও মুহা. স্বপন মিয়া এবং দুজন উদ্দ্যোক্তা (ইউপি চেয়ারম্যান কর্তৃক কমিশনের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি) সারোয়ার ও শহীদুল হকের সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। এ সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় ভিজিডি কার্ডধারীদের কাছ থেকে প্রতিমাসে চাল বিতরনের সময় ২২০ টাকা করে তোলা হয়েছে। গত তিন-চার মাস পূর্বে বর্তমান সচিব কৃঞ্চ চন্দ্র সরকার দায়িত্বে আসার পর তিনি এই টাকা উপকারীরভোগীদের কাছ থেকে গ্রহণ করেননি। মদনের অন্যান্য ইউপিতে ভিজিডি কার্ডধারীদের কাছ থেকে কোন প্রকার টাকা নেওয়া হয় না।
তিনি আরও বলেন, ১৫ মাসের প্রথম পাঁচ মাস হিরণ সচিবের পরে স্বপন সচিব এই দুজনের আমলে কার্ডধারীদের কাছে থেকে ২২০ টাকা করে নিয়েছে। তবে হিরণ সচিব বদলি হয়ে গেলেও তার কথা মতো কাজ করতে ও চলতো হতো স্বপন সচিবকে। এই টাকা উপকারভোগীদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়া হয়নি। কার্ডাধারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. হাদিস মিয়াসহ সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যরা এবিষয়ে চুপ থাকতে বলেন। এরই মধ্যে উদ্দ্যোক্তা সারোয়ার বিদেশে চলে গেছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মামলার কারণে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে। বদলীজনিত কারণে সাবেক সচিবদের একজন হিরণ মিয়া গোবিন্দ্রশ্রী ইউপিতে ও আরেকজন স্বপন মিয়া মদন ইউপিতে সেখানে সচিবের দায়িত্বপালন করছেন। এই দুজন ইউপি সচিবের আমলে ১৫ মাসে ২৭০ জন ভিজিডি কার্ডধারীদের কাছ থেকে প্রায় আট লক্ষ ৯১ হাজার টাকা উত্তোলিত হয়েছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিধি বহির্ভূতভাবে টাকা তুলেছেন। আমিসহ অন্যান্য মেম্বাররা এখন বিব্রতকর অবস্থায় আছি।
এ ব্যাপারে সচিব হিরণ মিয়া বলেন, ভিজিডি কার্ডের তালিকা ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে তৈরি করেছিলাম। আমি থাকাকালীন সময়ে চার মাসের ভিজিডির চাল বিতরণ হয়নি। বদলি হয়ে চলে আসার পর ওই চার মাসের চাল বিতরণ করেছে পরবর্তী সচিব। ভিজিডি চাল বিতরণে অর্থ নেওয়ার সাথে আমার সম্পৃক্ততা নেই।
সচিব মো. স্বপন মিয়া বলেন, কাইটাইল ইউপির সচিবের দায়িত্বে থাকাকালীন ১০ মাস নায়েকপুর ইউপিতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছি। আগের সচিব হিরণ মিয়া ভিজিডি কার্ড থেকে ২২০ টাকা নেওয়ার প্রথা চালু করে গেছেন। তার প্রথাই অনুসরণ করেছি। উত্তোলিত টাকা সঞ্চয়ের জন্য উদ্দ্যোক্তা সারোয়ার ও শহীদুল তারা দুজনে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কার্ডধারীদের হিসাবে জমা দেয়। ‘একই সময়ে কাইটাইল ইউপিতে সচিবের দায়িত্ব পালনের সময় ভিজিডি কার্ডধারীদের কাছ থেকে কোন টাকা নিয়েছেন কি?’ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে তিনি (স্বপন) বলেন, সেখানে টাকা নেওয়ার প্রথা চালু নেই।
উদ্দ্যোক্তা শহীদুল হক বলেন, উদ্যোক্তা সারোয়ার ভাই ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ছিলেন। তাকে টাকা তুলতে দেখেছি। আমি তার সহকারী হিসেবে ভিজিডি কার্ডে লেখালেখি করেছি। তিনি বিদেশে চলে গেলে তার জায়গায় দেড় মাস উদ্দ্যোক্তার দায়িত্ব পালন করেছি। এ সময়ে কার্ডধারীদের উত্তোলিত টাকা ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে দেখি উপকারভোগীদের নামে ব্যাংকে হিসাব নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানায়। সম্ভবত গত এপ্রিল মাসে যৌথ ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। সেখানে আমার তোলা এক লক্ষ ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়েছি।
বর্তমান ইউপি সচিব কৃঞ্চ চন্দ্র সরকার জানান, এখানে যোগদানের পর আমার আমলে ভিজিডি কার্ডধারীদের কাছ থেকে টাকা তোলা হয় নাই। চলতি মাসের ১২ তারিখ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও আমার নামে যৌথ ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। উদ্দ্যোক্তা শহীদুল আজ (মঙ্গলবার) টাকা জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। ‘রেজুলেশন ছাড়া ব্যাংক হিসাব খোলা বা ঊর্ধ্বতনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কিনা’ এমন প্রশ্নে তার কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাদিস মিয়ার মোবাইল বন্ধ ও আত্মগোপনে থাকায় এবং উদ্দ্যোক্তা সারোয়ার বিদেশে অবস্থান করায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।