মনিরুজ্জামান খান গাইবান্ধা,
দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে গাইবান্ধার একমাত্র কৃষি ভিত্তিক ভারী শিল্প কারখানা নামে পরিচিত রংপুর চিনিকলের উৎপাদন কার্যক্রম।
কারখানা বন্ধ থাকায় আখচাষি আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের ব্যস্ততার চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখরিত কারখানা প্রাঙ্গণটি এখন গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অযত্ন অবহেলায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে দিন দিন।
প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার দায় মেটানো এ রংপুর চিনিকলটি এখনো চালু করা হয়নি। বরং চার বছর হলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চিনিকলটি।
অথচ আধুনিকায়নের নাম করে গাইবান্ধার লক্ষাধিক মানুষের আয়ের পথটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ শ্রমিক কর্মচারীর।তারা বলেন আজ আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি ।
এদিকে,এ চিনিকলের স্থায়ী চাকরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এখান থেকে অন্যত্র
কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় জঙ্গলে ভরে গেছে ৩৫ একর আয়তনের কারখানা চত্বরটি। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা প্রায় অর্ধ শতাধিক আখ পরিবহনের যানবাহন ও শত শত কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণকাজ। সে সময়কার ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরে শেষ হয় মিলটির নির্মাণকাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে।
পশ্চিম জার্মানির বাকাউ-উলফ নামের একটি কোম্পানি থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে মিলের কারখানা ও কার্যালয়। ১৯৭২ সালে রংপুর চিনিকলসহ সব কয়টি চিনিকলকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার।
চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য গড়ে তোলা হয় আবাসিক স্থাপনা। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা আট একর। সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং আটটি সাব-জোন।
এ ছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ এক হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। আর এ সময়কালে ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় চার লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।
শুধু তাই নয়, রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এখানকার পাওয়ার হাউসে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেলস্টেশনসহ সরবরাহ করা হতো উপজেলার বিভিন্ন জায়গায়। চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ।
সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহন করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ্বালানিসহ নানা দ্রব্য। চিনির কলটিকে ঘিরে জাঁকজমক ছিল মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন। সেই সুবাদে বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। জেলার শিক্ষার প্রসারেও অনন্য ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়। সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষিসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল ঐতিহ্যবাহী এ কারখানাটি।
সে সময় বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ও বিপুল পরিমাণ পরিপক্ব আখ জমিতে রেখে একেবারে শেষ মুহূর্তে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিক্ষুব্ধ আখচাষি ও শ্রমিক-কর্মচারীরা শুরু করেন ব্যাপক আন্দোলন।
কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন ও চাষদের করুণ আকুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মাড়াই কার্যক্রম। শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিরা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল, আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে এ চিনিকলসহ সব চিনিকল।
কাজ হারানো চুক্তিভিত্তিক অর্ধসহস্রাধিক শ্রমিক এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিকশা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে চালু রাখা পার্শ্ববর্তী চিনিকলের চেয়ে অধিক মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন ও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও রহস্যজনক কারণে এ কলটি বন্ধ করায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এলাকার হাজার হাজার আখচাষিসহ সাধারণ মানুষ।
চিনিকল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ৯০-এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে আধুনিকায়নের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি-বাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ্ব ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে।
ওই ঋণই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর জন্য। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ্ব ব্যাংকের এই ঋণ।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল কবির জানান, মিলটি পুনরায় চালুর বিষয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে, কবে নাগাদ এটি চালু হবে তা বলা মুশকিল। যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, বিশাল আয়তনের এই কারখানায় যানবাহন রাখার কোন শেড না থাকায় আখ পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।