আমিনুল হক, সুনামগঞ্জ
দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভুত সমস্যা নিয়ে চলছে সুনামগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসাপাতাল। সমস্যার মূল কারণ হিসেবে মানুষ চিহ্নিত করছেন হাসপাতালের ষ্টোরকিপার ও হিসাবরক্ষককে। এই দুজন হলেন ‘সুলেমান ও ছমিরুল। ভুক্তভোগীরা জানান ‘সুলেমান ও ছমিরুল এখন হাসপাতালের বড় সমস্যা।
এদেরকে নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সেবা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। গত ২৩ আগস্ট সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরীর মাধ্যমে এ স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন তারা।
জেলা প্রশাসক গত সোমবার বিকালে বলেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। এদিকে স্মারকলিপিতে বলা হয়, জেলা সদর হাসপাতালে শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই ৩২ খাতে প্রায় ১৮ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ ব্যাপারে ঐ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদনেও আপত্তি দেওয়া হয়েছে।
এ অনিয়মের সঙ্গে হাসপাতালের গুদামরক্ষক সুলেমান আহমদ, হিসাবরক্ষক ছমিরুলসহ কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে। সুলেমান ও ছমিরুলকে গত জুলাইয়ে বদলি করা হলেও পরে আবার তাদের পুরোনো কর্মস্থলে বহাল করা হয়।
তবে তাদের হাজিরা ও বেতন বন্ধ রাখা হয়েছে। অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওষুধ কেনা বাবদ সরকারের ৪৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা, কম্পিউটারের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, সিল ও স্ট্যাম্পপ্যাড ক্রয়, সভা-সেমিনার, অনুষ্ঠান আয়োজন ও আপ্যায়ন বাবদ ৮১ লাখ ৪ হাজার ২১৯ টাকা তোলা হয়েছে। প্রয়োজন না থাকলেও কেনা হয়েছে ২২ লাখ টাকার সার্জিক্যাল সামগ্রী।
পর্যাপ্ত আউটসোর্সিং জনবল থাকার পরও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই অনিয়মিত শ্রমিকের মজুরি দেখিয়ে ৮১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বেশি পরিমাণ ওষুধ ক্রয় দেখিয়ে সরকারের ১ কোটি ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ক্ষতি করা হয়।
আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ না করলেও ঠিকাদারকে ১৫ লাখ ২৯ হাজার ৭৫০ টাকা বিল দেওয়া, মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন ও খরচ মঞ্জুরি ছাড়া ৯৭ লাখ ৭১ হাজার ১২৭ টাকা বকেয়া বিল দেওয়া, চাহিদা ছাড়া প্রায় ৪৩ লাখ টাকায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত লিনেনসামগ্রী কিনে বাক্সবন্দি রাখা হয়েছে।
বাস্তবে বর্জ্য সংরক্ষণাগার ও অফিস সরঞ্জাম মেরামত না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১৩ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের কেবিন ভাড়া থেকে পাওয়া প্রায় ২১ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে হাসপাতালের অডিট প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, হাসপাতালের জন্য ওষুধ, যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক ও লিনেনসামগ্রী কেনাকাটায় সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে উচ্চদরে কাজ দেওয়া হয়।
এতে সরকারের ২ কোটি ৫৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৬৯ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অফিসিয়াল প্রয়োজনে এ সময়ে ৩ হাজার ৭২০টি সিল ও স্ট্যাম্প কেনা হয়। এতে ব্যয় হয়েছে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
সুনামগঞ্জ শহরের শফিক আর্ট, শ্যামল ফটোস্ট্যাট ও পিনাক আর্টের নামে বিল ভাউচার করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে, তারা এসব পণ্য সরবরাহ করেনি। মেসার্স সামিহা এন্টারপ্রাইজ নামে সুনামগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৬৭ লাখ টাকার বিল দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে মনিহারি, অফিস সরঞ্জাম ও অন্যান্য সামগ্রী কেনাকাটা বাবদ ২২ লাখ ৯১ হাজার টাকা, অফিস আসবাব ও সরঞ্জাম সরবরাহ না করলেও ১৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা, অনাবাসিক ভবনের বর্জ্য সংরক্ষণাগার ও অফিস সরঞ্জাম মেরামত না করলেও ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, আসবাব মেরামত না করলেও ১৫ লাখ টাকার বিল দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, এ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান মূলত গুদামরক্ষক সুলেমান আহমদ ও হিসাবরক্ষক ছমিরুল ইসলামের।
শহরের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার্য দ্রব্য কেনার নামে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাপোশ কেনার ১২ লাখ টাকার বিল রয়েছে। তবে সুলেমান আহমদ ও মো. ছমিরুল ইসলাম কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন।
হাসপাতালের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সুলেমান ও ছমিরুল এখন হাসপাতালের বড় সমস্যা। মূলত এরাই সব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। আমাকেও তারা নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দিচ্ছে। আমি প্রশাসন ও পুলিশকে জানিয়েছি।’