সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আয়ের একমাত্র উৎস যেন ছিলো সুনামগঞ্জ জেলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল। বিগত সময়ে ভূয়া বিল ভাউচার তৈরি করে অর্থ হরিলুট করাই যেন ছিলো তাদের মূল লক্ষ্য। আর এ সব অর্থ লুটের মূল কারিগর হাসপাতালের ষ্টোর কিপার সুলেমান ও হিসাব রক্ষক ছমিরুল ইসলাম নামক দুই ব্যক্তি। তারা দুজনে মিলে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের সহায়তায় জিনিস পত্র ও ঔষধ ক্রয়ের নাম করে ভুয়া বিল ভাচাউচার করে অবাধে টাকা হাতিয়ে নেন। বিপত্তি বাধে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের নতুন উপ-পরিচালক ডা: মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক দায়িত্ব নেয়ার পর।
চক্রটি পূর্বের ন্যায় নতুন উপ-পরিচালক ডা: মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এর কাছে ভূয়া বিল ভাউচারে স্বাক্ষর নিতে গেলে তিনি তাতে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ায় স্বাক্ষর করেননি। আর এ কারণেই মূলত দ্বন্দের সৃষ্টি হয়।
ঠিক ঐসময় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের নতুন উপ-পরিচালক (তত্ত্বাবধায়ক) ডা: মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে জামায়ত শিবিরের লোকআখ্যা দিয়ে মাহবুবুর রহমানকে অন্যত্র বদলি করার জন্য তৎকালিন স্বাস্থ্য মন্ত্রী সামান্ত লাল সেন বরাবর ডিও দেন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন। এ ছাড়াও অপরিচিত ফোন নাম্বার থেকে নানান ভাবে হত্যার হুমকি দেয়া হয় ডা: মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে।
এ ব্যপারে জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এটা আনফরচুনেটলি হয়ে গেছে। আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে পারবও না।
সূত্র জানায়, হাসপাতালে যে সকল পণ্য ক্রয় করতে গিয়ে ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে হরিলুট করা হয়েছে সেগুলো হল অটোমেশন যন্ত্র ক্রয় করা হয় ২০১৮ সালে। এই মেশিনের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয় দেখিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চার কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিল তোলা হয়। সদর হাসপাতালের ১৯টি কম্পিউটারের ক্ষুদ্র যন্ত্রাপাতি ক্রয় ও মেরামত দেখিয়ে প্রায় ২৪ লাখ, অনুষ্ঠান, উৎসব, সভা-সেমিনারের ব্যয় ২৪ লাখ, আপ্যায়ন ২১ লাখ, পাপোস কেনায় ১৪ লাখ, সিল ও স্ট্যাম্পপ প্যাড কেনায় ১১ লাখ টাকার বিল তোলা হয়েছে।
জেলা সদর হাসপাতালে কেবল ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরেই অনুমানিক ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ওই অর্থ বছরের অডিট প্রতিবেদন তাই বলছে। এই অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িত হাসপাতালের স্টোরকিপার সুলেমান আহমদ, হিসাবরক্ষক মো. ছমিরুল ইসলাম ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মো. আনিসুর রহমান জড়িত। হাসপাতালে কেনাকাটাসহ ৩২টি খাতে অর্থ ব্যয়ে ১৮কোটি টাকার অডিট আপত্তি পড়েছে।
এই সকল অর্থ ছাড়ের সময় হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মো. আনিসুর রহমান। বর্তমানে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক। সুলেমান ও ছমিরুলকে হাসপাতাল থেকে বদলি করা হলেও মো. আনিসুর রহমান তার ক্ষমতা বলে আদেশের মাধ্যমে আবার তাদের সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে বহাল করেন।
বিগত সময়ে ঔষধ, যন্ত্রপাতি, ক্যামিকেল ও লিলেনসামগ্রী ক্রয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয় নি। এতে চারটি কেনাকাটায় সরকারের দুই কোটি ৫৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৬৯ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়। সরকারের এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানী লিমিটেড (ইউসিএল) থেকে ঔষধ না ক্রয় করায় সরকারের ৪৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। কম্পিউটারের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, সিল ও স্ট্যাম্পপ্যাড ক্রয়,সভা-সেমিনার, অনুষ্ঠান আয়োজন ও আপ্যায়ন বাবদ ৮১ লাখ ৪ হাজার ২১৯ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। প্রয়োজন না থাকা সত্বেও ২২ লাখ টাকার স্যার্জিকেল সামগ্রী ক্রয় করা হয়েছে।
পর্যাপ্ত আউটসোর্সিং জনবল থাকা সত্বেও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া অনিয়মিত শ্রমিকদের মজুরি দেখিয়ে ৮১ লাখ ৭০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে অধিকহারে ইউসিএল বহির্ভূত ওষুধ ক্রয় দেখিয়ে সরকারের এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে ১৫ লাখ ২৯ হাজার ৭৫০ টাকা বিল প্রদান, মন্ত্রলণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন ও ব্যয় মঞ্জুরি ব্যতিত ৯৭ লাখ ৭১ হাজার ১২৭ টাকা বকেয়া বিল প্রদান, চাহিদা ছাড়া প্রায় ৪৩ লাখ টাকায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত লিলেন সামগ্রী ক্রয় করে বাক্সবন্দী রাখা হয়েছে।
প্রধান স্টোর থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিতরণকৃত লিলেন সমাগ্রী গ্রহণের পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন না করতে পারায় সরকারের ক্ষতি ৪৬ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৫ টাকা। বাস্তবে বর্জ্য সংরক্ষণাগার ও অফিস সরঞ্জাম মেরামত না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১৩ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের কেবিনে ভর্তিকৃত রোগীর কেবিন ভাড়া থেকে প্রাপ্ত প্রায় ২১ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অফিসিয়াল প্রয়োজনে এ সময়ে তিন হাজার ৭২০ টি সিল ও স্ট্যাম্প ক্রয় করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ১১ লাখ ৫০হাজার হাজার টাকা। সুনামগঞ্জ শহরের শফিক আর্ট, শ্যামল ফটোস্ট্যাট ও পিনাক আর্ট’র নামে বিল ভাউচার করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে তারা এসব সরবরাহ করেননি।
মেসার্স সামিহা এন্টারপ্রাইজ নামে সুনামগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৬৭ লাখ টাকার বিল দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মনিহার, অফিস সরঞ্জাম ও অন্যান্যসামগ্রী ক্রয় বাবদ ২২ লাখ ৯১ হাজার, অফিস আসবাব ও সরঞ্জাম সরবরাহ না করলেও ১৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা, অনাবাসিক ভবনের বর্জ্য সংরক্ষণাগার ও অফিস সরঞ্জাম মেরামত না করলেও ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, আসবাবপত্র মেরামত না করলেও ১৫ লাখ টাকার বিল প্রদান করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, এই প্রতিষ্ঠান মূলত স্টোর কিপার সুলেমান আহমদ ও হিসাবরক্ষক মো. ছমিরুল ইসলামের। তারা আড়ালে থেকে এই প্রতিষ্ঠানের নামে বিল নিতেন।
শহরের মেসার্স জননী ক্লথ স্টোর, মেসার্স রায় ট্রেডার্স ও মেসার্স অনিক ট্রেডার্স নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ক্রয়ের নামে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পাপোসই আছে ১২ লাখ টাকার।
সুলেমান মিয়া বলেন, আমার সাথে উনার দেখাই হয় নাই। আমি উনাকে কিছুই বলিনি। উনি যদি থানায় অভিযোগ দিয়ে থাকেন তা হলে এগুলো মিথ্যা। উনার সাথে আমাদের কোনও হিসাব নেই। আমরা কোনও কাগজ পত্র নিয়ে যাই নি উনার কাছে। উল্টো উনি ডায়ালাইসিসের মালামাল ক্রয় করে ঠিকাদারের টাকা আটকে রেখে দিয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মো. আনিসুর রহমান (বর্তমানে কর্মরত বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য, সিলেট) তাকে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের বর্তমান তত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, সুলেমান ও ছমিরুলই সুনামগঞ্জের এক আওয়ামীলীগ নেতার ছত্রছায়ায় এ সব অপর্কম করেছে। মূলত এরাই সব অনিয়ম-দুনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমাকেও তারা নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দিচ্ছে। আমি প্রশাসন ও পুলিশকে সব অবহিত করেছি। নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়রি করেছি।