রুহুল আমিন,ডিমলা(নীলফামারী)
সাম্প্রতিক সময়ে সমাজসেবা কার্যালয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা তুলতে যান হামিদুল ইসলাম নামের একজন বৃদ্ধ। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন তিনি মারা গেছেন। তার নামের বরাদ্দ করা বয়স্ক ভাতা বাতিল করা হয়েছে। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে এই বৃদ্ধ ভাতা পাচ্ছেন না। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। হামিদুল ইসলাম উপজেলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের পুর্নারঝাড় গ্রামের বাসিন্দা।
তিনি জানান, পাঁচ বছর নিয়মিত বয়স্ক ভাতা পেয়েছেন। গত ৬/৭ মাস আগে হঠাৎ তার ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভাতার টাকা তুলতে স্ত্রীসহ একাধিকবার সমাজসেবা কার্যালয়ে আসেন তিনি। অফিস সূত্রে তাকে জানানো হয়, ভাতা ভোগীদের তালিকায় তাকে মৃত দেখানো হয়েছে। তাই ভাতার কার্ড বাতিল করা হয়েছে। জীবিত থাকতে কীভাবে মৃত দেখানো হলো! কারা এমনটি করলেন! এর কিছুই জানেন না ভুক্তভোগী।
হামিদুল ইসলাম বলেন, সংসারের ঘানি টানতে এই বৃদ্ধ বয়সেও দিনমজুরির কাজ করি। সরকারের দেওয়া এই টাকা তাদের একটা স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এদিকে নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে দিনের পর দিন সমাজসেবা কার্যালয়ে যাতায়াত করতে বেশ টাকাও খরচ হয়েছে তার। এ জন্য স্থানীয় এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছে সুদের ওপর দেড় হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। এখন সেই সুদের টাকাও বেড়ে সুদে-আসলে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন টাকা পরিশোধের চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাঁটছে তার।
শুধু ওই হামিদুল ইসলাম নয়, তার মত অনেক জীবিত ভাতাভোগী এখন কাগজে কলমে মৃত বলে জানা গেছে। তারা দিব্যি বেঁচে থাকলেও ভাতার টাকা পাচ্ছেন না।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জীবিত থেকেও কাগজে কলমে মৃত দেখিয়ে সুবিধাভোগীদের ভাতার কার্ড বাতিল করেছে সমাজসেবা কর্মকর্তা। শতাধিক ভাতাভোগীর মোবাইল নম্বর গোপনে পরিবর্তন করে ভাতা বঞ্চিত করা হয়েছে। এসব বিষয়ে অভিযোগ জানালে হয়রানি ও অসদাচরণ করেন ওই অফিস কর্মকর্তা।
ভুক্তভোগীদের দাবি, মাসে ৬০০ টাকা ভাতা একজন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত না হলেও এটি নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান। তাই তারা এ সম্মান ফিরে পেতে চান।
উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৬ হাজার ২৩০ জন। এরমধ্যে বয়স্ক ভাতা ১২ হাজার ১৮৫, প্রতিবন্ধী ভাতা ৬ হাজার ৪৭ ও বিধবা ভাতাধারী ৭ হাজার ৮৯৮।
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের আজিরন বেওয়া ৭ বছর ধরে বয়স্ক ভাতা পেয়েছেন। তবে গত নয় মাস ধরে আর ভাতার টাকা পাচ্ছেন না। স্থানীয় ইউপি সদস্যের সহায়তায় সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন কাগজে কলমে তিনি মৃত।
তাই ভাতা বন্ধ! কে এমন কাজ করেছে তা জানেন না ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্য। এ নিয়ে রীতিমতো হতবাক বয়সের ভারে নুয়ে পড়া আজিরন বেওয়া। তেমন কিছু ভালো করে বলতেও পারেন না। কথাও বোঝেন কম। একমাত্র ছেলে ও স্বামীর মৃত্যুর পর বয়স্ক ভাতার টাকা ও স্বজনদের সহযোগিতায় চলছিল তার সংসার। কিন্তু ভাতা বন্ধ হওয়ায় নিজের চিকিৎসাও করাতে পারছেন না তিনি।
তিনি বলেন, ইউপি সদস্য ওহাব আলীর মাধ্যমে জানতে পারি ভাতাভোগীদের তালিকায় আমাকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বাতিল করা হয়েছে। এরপর সমাজসেবা অফিসে গিয়েছি। তারা আমার কাগজপত্র দেখেছে। মৃত তালিকা থেকে নাম কাঁটতে খরচ বাবদ কিছু টাকাও চেয়েছে। কিন্তু আমি দিতে পারিনি।
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ওহাব আলী বলেন, আজিরন বেওয়ার বয়স প্রায় ৭৫ বছর। তিনি অত্যন্ত অসহায় মানুষ। তাকে সব সময়ই কিছু দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সমাজসেবা কার্যালয়ের লোকজন মৃত দেখিয়ে ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে। এটা ভাবা যায়!
তিনি আরো বলেন, আমার গ্রামে কোন লোকের মৃত্যু হলে অবশ্যই আমার জানার কথা। এই মৃত্যুর বিষয়টি হাস্যকর। আমাদের ইউনিয়নে আরও ২০/২৫ জন সুবিধাভোগীর একই সমস্যা হয়েছে।
ছয় মাস ধরে প্রতিবন্ধী ভাতা পান না কুমার পাড়া গ্রামের রিতা রায়। তার দাদী নিরোদীনি রায় বলেন, নাতনির ভাতার টাকা কোথায় যাচ্ছে? কেন পাচ্ছি না? তা জানতে সমাজসেবা অফিসে ৩ মাস ধরে ঘুরছি। কিন্তু সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে ভাতার খোঁজ নিতে গিয়ে চরমভাবে অপদস্থ হয়েছি। ওই কর্মকর্তা দুর্ব্যবহার করে বলেছেন, ভাতা পাবেন না। সরকার টাকা না দিলে আমি কোথায় থেকে টাকা দেব।
একই অভিযোগ করে উত্তর তিতপাড়া গ্রামের মকবুল হোসেন বলেন, আগে নিয়মিত বয়স্ক ভাতা পেলেও দেড় বছর ধরে টাকা পাচ্ছিনা। এই দীর্ঘ সময় ধরে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে ঘুরঘুর করছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু সুবিধাভোগীরা নয়, সেবা নিতে আসা অন্যরাও হয়রানির শিকার হন এই কার্যালয়ে। উপজেলার রুপাহারা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা হাজরা বেগম বলেন, ওই অফিসের স্যারের (সমাজসেবা কর্মকর্তা) দুর্ব্যবহারে আমরা অতিষ্ঠ। তিনি ধমক দিয়ে তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। অফিস কক্ষে ঢুকতে দেন না। শুধু ঘুরায়। এমন অফিসার থাকলে গরিব অসহায় মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে বলেন ভুক্তভোগীরা।
উপজেলার খালিশা চাপানি ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান সরকার জানান, তার ইউনিয়নের হামিদুল ও আজিরন বেওয়া জীবিত রয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের কখনো মৃত ঘোষণা করা হয়নি। তাদের নামে মৃত্যু বা অন্য কোন সনদও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
মৃত্যু সনদ ছাড়া ভাতা বাতিলের বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নুরুন্নাহার নুরী বলেন, ‘ভাতাভোগীদের সঠিক (লাইভ ভেরিফিকেশন) যাচাই-বাছাইয়ের সময় যাদের পাওয়া যায়নি। নিরুদ্দেশ দেখিয়ে তাদের ভাতার কার্ড বাতিল করা হয়। নতুন সুবিধাভোগীর নাম প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ সংখ্যা ৫/৬ জনের বেশি নয়।
নিরুদ্দেশ ব্যক্তিদের প্রত্যয়ন পত্র বা মৃত্যু সনদ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা নিরুদ্দেশ ব্যক্তিদের তালিকা দিয়েছেন। তবে তালিকার কপি দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় সেবা গ্রহীতাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, মৃত্যু সনদ ছাড়া ভাতা বাতিলের কোনো সুযোগ নেই। এ ঘটনায় তদন্ত করে কোনো অনিয়ম পেলে ঊর্ধ্বতন