তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের কৃষক পরিবারের সন্তান সাজ্জাদুল ইসলাম। এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী কলা গাছের তন্তু দিয়ে প্লাস্টিক, কার্বন ও সিলিকন পণ্যের বিকল্প ব্যবহারযোগ্য পরিবেশ-বান্ধব পণ্য তৈরির ফরমুলা আবিষ্কার করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। একইসাথে সে পচা বা অব্যবহৃত সবজীর শ্বেতসার থেকে তৈরি করেছে পচনযোগ্য পলিথিন। সাজ্জাদুলের দাবি এটি পরিবেশ- বান্ধব এবং অনেকটা সাশ্রয়ী।
শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল জানায়, শুধু প্লাস্টিকের আসবাবপত্র নয় তার আবিষ্কৃত কাঁচামাল দিয়ে টাইলস, কার্বন ও সিলিকনে তৈরি, টিন ও কার্বনের তৈরি মোটরযানের যন্ত্রাংশের বিকল্প হিসেবে কলাগাছের তত্ত্ব ব্যবহার করা সম্ভব। এমনকি বুলেট প্রুফ দরজা জানালাও তৈরি করা সম্ভব।
সাজ্জাদুল ইসলাম শ্রীমঙ্গল আশিদ্রোণ ইউনিয়নের মোহাজেরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা গৃহিণী সাহেরা বেগম ও কৃষক মো. নজরুল ইসলামের সন্তান। ছেলের এমন কৃতিত্বে অভিভূত তারাও। সাজ্জাদুলের এমন আবিষ্কার নিয়ে হইচই পড়ে গেছে সারাদেশে।
সাজ্জাদুল ইসলাম জানায়, কলাগাছের তত্ত্ব থেকে তৈরি এই কঠিন যৌগ তৈরি করতে তার সর্বোচ্চ ৬৫ ভাগ তন্তুর সাথে রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রণ হবে।
সাজ্জাদুল ইসলামের দাবী, তার তৈরি টাইলসের ওজন পায় ৩০০ গ্রাম। যার মধ্যে ২০০ গ্রাম কলাগাছের তন্তু, হার্ডনার ৬০ গ্রাম ও পলিপ্রপিলিন ৪০ গ্রাম। সে আরও জানায়, পলিপ্রপিলিন ব্যবহার করার কারণে দীর্ঘদিন এটিকে পচন থেকে রোধ করবে এবং হার্ডনার পলিপ্রপিলিনের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
তার আবিষ্কৃত প্লাস্টিক পণ্য উচ্চ তাপে গলিয়ে সহজেই রাসায়নিক দ্রব্য ও কলাগাছের তত্ত্ব আলাদা করা য়ায়। আর সবজির শ্বেতসার থেকে তৈরি পলিথিন মাটিতে ১ মাসে ও পানিতে ৩ মাসে পচে যাবে। যা মাটির জন্য হবে জৈব সার ও পানিতে হবে মৎস্য-খাদ্য।
পরিবেশ-বান্ধব পলিথিনের জন্য সে ব্যবহার করে বাজারের পরিত্যাক্ত সবজি থেকে সংগ্রহকৃত শ্বেত সার, অ্যাসিটিক এসিড ও গ্লিসারল। মোট দ্রবণের ২৫ শতাংশ গ্লিসারল, ২৫ শতাংশ এসিটিক এসিড ও ২৫/৩০ শতাংশ পানি ও বাকিটা সবজির শ্বেতসার।
ইতোপূর্বে সাজ্জাদুল “বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা-২০২৪” এ মৌলভীবাজার জেলা পর্যায়ে বছরের সেরা মেধাবী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। সে জানায়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সে তার গবেষণা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
একই কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক হৃদয় কুমার ভৌমিক জানান, সাজ্জাদুল কলাগাছের সেলুলোজ সমৃদ্ধ তন্তু এর হাইডোঅক্সাইড ও রেজিন ব্যবহার করে একটুরো টাইলস তৈরি করে এবং আলুর শ্বেতসার থেকে পলিথিন তৈরি করে এনে দেখায়। পরে আমরা কলেজের ল্যাবে তাকে এটি করে দেখানোর আহ্বান জানালে, কলেজের ল্যাবে এই দুই পণ্য তৈরি করে। এ সময় অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও তা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে। তিনি বলেন, সে যে কাঁচামাল ব্যবহার করেছে তা পরিবেশের ভারসাম্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আরও অধিক গবেষণায় এটি ভালো কোনো আবিস্কার হতে পারে বলে মতামত ব্যক্ত করেন।
কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিজন চন্দ্র দেবনাথ জানান, যেহেতু এর প্রধান কাঁচামাল কলাগাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং কলাগাছ সহজলভ্য তাই এটির ব্যবহারে গ্লাস ফাইবার ও কার্বন ফাইবারের প্রয়োগ কমবে। এতে পরিবেশের উপর অপচনশীল প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমবে।
সাজ্জাদুলের বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। তার বাবার পক্ষে তার গবেষণার খরচ চালানো সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক কারণে তার সামনের দিকে এগুনো হচ্ছে না। এই মেধাবী ক্ষুদে বিজ্ঞানীর অগ্রযাত্রায় সরকার বা প্রতিষ্টান পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসলে তার দ্বারা আরো ভালো কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হবে বলে আশা করেন তার শিক্ষকরা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ফল ও সবজি অপচয় হয়। এই অপচয়কৃত শস্য থেকে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার যোগ্য পণ্য তৈরি করা হলে পরিবেশ দূষণ রোধের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে আসতে পারে বড় একটা পরিবর্তন। আর কলাগাছ যেহেতু একবার ফল দেয়ার পর কেটে ফেলা হয়, তাই কৃষককের কাছ থেকে অল্প মুল্যে তা সংগ্রহ করে এর দ্বারা প্লাস্টিক, কার্বন ও সিলিকন পণ্যের বিকল্প হিসেবে পরিবেশ-বান্ধব ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরি করা সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশ সচেতনরা।