তাসলিমুল হাসান সিয়াম,গাইবান্ধা প্রতিনিধি: কৃষি অর্থনীতি নির্ভর উত্তরের জেলা গাইবান্ধার অধিকাংশ পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস ফসল উৎপাদন। আবহাওয়া নির্ভর কৃষি ব্যবস্থায় লাভ ক্ষতির সমীকরণ তাই অনেকটা নির্ভর করে প্রকৃতির আচরণের উপর । আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ফলন বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কম হয় আর প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি খরচ বেড়ে যায় । প্রকৃতির এসব নিয়মকানুনের সাথে অনেকটা মানিয়ে নিয়ে চাষাবাদ করছে গাইবান্ধার কয়েক লক্ষাধিক কৃষক।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলের কৃষকদের নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চাষাবাদ করতে হচ্ছে। তীব্র তাপদাহ ও খরার কারণে একদিকে যেমন বাড়ছে ফসল পুড়ে যাওয়ার শঙ্কা তেমনি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেওয়ায় বাড়ছে উৎপাদন খরচ ।
জানা যায়, বোরো মৌসুমের শুরু থেকে , বিশেষত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে সেচ মৌসুমে বৃষ্টিপাতের অভাবে খরচ বেড়েছে। তাই ফসল উৎপাদন ও সব খরচ মিটিয়ে লাভ নিয়ে শঙ্কায় আছেন কৃষকরা।
তাপদাহ, তীব্র খরা এবং স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না থাকায় জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আংশকাজনকহারে নিচে নেমে যাওয়ায় আরও অতিরিক্ত খরচ যোগ হয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে এবারের বোরো চাষের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি। প্রচন্ড খরার কারণে কিছু অঞ্চলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দেড়গুণ-দুইগুণ পর্যন্ত বেশি খরচ করে সেচ দিতে হয়েছে।
বোরো চাষী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খরার কারণে অঞ্চলভেদে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সেচ দিতে হয়েছে। এতে করে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু খরার প্রভাবে বাড়তি সেচ দেওয়ার পরেও কৃষকরা বোরো ধানের স্বাভাবিক উৎপাদন ধরে রাখতে পারছেনা ।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার কৃষক আলমগীর হোসেন এ বছর ৬ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেন। গত বছর বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা সেচ খরচ হলেও এবারে খরচ হয়েছে ২০০০ টাকা।
একই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের বাগদা বাজারের চাষী মমিনুল হক , তিনি জানান আমাদের এই এলাকায় পানির স্তর প্রতি বছর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নামছে । অগভীর নলকূপে কাজ না হওয়ায় কয়েক বছর আগে গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এতেও চাহিদা অনুযায়ী পানি পাওয়া যাচ্ছে না । বর্তমানে চৈত্র মাস চলছে , কৃষি বিভাগ থেকে জমিতে পানি ধরে রাখার কথা বললেও সেচ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ফসল পুড়ে গিয়ে বড় ধরনের লোকসান হবে ।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ধানের কেজি প্রতি উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১ পয়সা, চালের ৩৮ টাকা ৯৬ পয়সা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১৯ পয়সা, চালের ৩৮ টাকা ৫৩ পয়সা; বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৫ টাকা ২৮ পয়সা, চালের ৩৭ টাকা ৭ পয়সা এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৭ টাকা এবং চালের ৩৯ টাকা নির্ধারণ করেছে।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৬৫ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ২১ হাজার ৩০৫ হেক্টর, ফুলছড়িতে ৮ হাজার ৩০৪, সাঘাটায় ১৪ হাজার ৭০৪, সাদুল্যাপুরে ১৪ হাজার ৪০৮, পলাশবাড়ীতে ১১ হাজার ৮০৯, গোবিন্দগঞ্জে ৩১ হাজার ১০৫ এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ২৬ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
জানা গেছে, শুধু ধান নয় বৃষ্টি নির্ভর পাটের আবাদে এবার খরার কারণে শ্যালো মেশিনে সেচ দিতে হচ্ছে। বাড়তি সেচ দিয়েও পাটগুলো বাঁচানো যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাটচাষিরা জানিয়েছেন, তীব্র তাপদাহ ও অনাবৃষ্টিতে চৌচির বিভিন্ন স্থানের পাটক্ষেত। বৈশাখের তপ্ত রোদে শুকিয়ে যাচ্ছে পাটগাছ। এতে পাটের আবাদ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষকের মধ্যে।
অপরদিকে ধারাবাহিক তীব্র তাপদাহের কারণে নেমে গেছে পানির স্তর। পাটের জমিতে ঘন ঘন সেচ দেওয়ায় যেমন বাড়ছে উৎপাদন খরচ, তেমনি প্রচন্ড খরায় জমির আগাছা পরিষ্কার করতে পারছেন না কৃষকরা। এতে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষীরা।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম জানান , জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাত । এবছর চৈত্র মাসে গাইবান্ধা জেলার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী হতে পারে। কৃষি অফিস থেকে, জমিতে পানি সংরক্ষণের করণীয় বিষয় সম্পর্কে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে উৎপাদন খরচ কিভাবে কমানো যায় সে ব্যাপারে কৃষকদের সাথে নিয়ে নিয়মিত উঠান বৈঠক করা হচ্ছে।