তাসলিমুল হাসান সিয়াম,গাইবান্ধা প্রতিনিধি: উনিশ শতকের শুরুতে গাইবান্ধায় সংস্কৃতি চর্চার বিপ্লব ঘটে । তৎকালীন সময়ে গাইবান্ধার সংস্কৃতিমনা ও বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গের অর্থায়নে নির্মিত হয় বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।এসব সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো জেলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের হাট বাজারে, মাঠে, পাড়ায় কিংবা মহল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাপালার আয়োজন করত। জোৎস্না রাতে সামাজিক এ যাত্রাপালা দেখতে ছোট বড় সব বয়সীরা দল বেঁধে ছুটে যেতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন এই যাত্রাপালা।
জানা যায় নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিলো এই যাত্রাপালা। আর যাত্রাপালার কাহিনী আর গল্পগুলো বেশির ভাগই সমাজে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা নিয়ে তৈরি করা হতো। এ সংস্কৃতি মানব সমাজ ও রাষ্ট্রের সামাজিক অবক্ষয় দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম নিদর্শন এই যাত্রাপালা আজ বিলুপ্ত প্রায়।
একদিকে যেমন হারিয়ে যেতে বসেছে যাত্রাপালা অন্যদিকে যাত্রাপালার শিল্পীরা হয়ে পড়েছেন বেকার। ফলে জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে যাত্রাপালার অভিনয় জগত থেকে সরে যাচ্ছেন তারা।
সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো যাত্রাপালা কিংবা পালা নাট্য আয়োজন নিয়ে উদাসীন থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ে মাঝে মাঝেই শহর ও গ্রামে ঐতিহ্য লালন করে টিকে থাকা নাট্য সংস্থাগুলো পালানাট্যের আয়োজন করে। সম্প্রতি গাইবান্ধা সদর উপজেলার দারিয়া পুর নামক স্থানে সারথী নাট্য থিয়েটার নামের একটি সংগঠন তাদের ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিন দিন ব্যাপী পালা নাট্য উৎসবের আয়োজন করে ।
গাইবান্ধা কেন্দ্রিক নাট্যচর্চার এ দলটির তিনদিনের পালানাট্য উৎসবে গিয়ে দেখা যায় বিপুল দর্শক উপস্থিতি । তিনদিনের এই নাট্যোৎসবে তিনটি পালানাটক পরিবেশিত হয় বলে জানান আয়োজক কর্তৃপক্ষ। প্রথম দিন পরিবেশিত হয় সেলিম আল দীনের ‘যৈবতী কণ্যার মন’ অবলম্বনে সারথী থিয়েটারের ‘কালিন্দীর গীত’ নাটকটি। এটি রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন সায়িক সিদ্দিকী। দ্বিতীয় দিন মঞ্চস্থ হয় আসমা আক্তার লিজার রচনা ও নির্দেশনায় নাট্যনন্দন ঢাকার নাটক ‘বিষ পবনের গীত’ এবং তৃতীয় দিন রূপবান গাঁথা অবলম্বনে সায়িক সিদ্দিকীর রচনা ও নির্দেশনায় পাঁচবিবি থিয়েটার জয়পুরহাটের নাটক ‘রূপবান কইন্যার পালা’।
পালা নাট্য উপভোগ করতে আসা সদর উপজেলার রুপার বাজারের ৫৮ বছর বয়সী মতিন সরকার বলেন , এক সময় চিত্ত বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল যাত্রাপালা। আমারা তখন খুব আগ্রহ নিয়ে এই অনুষ্ঠানগগুলো উপভোগ করতাম। কৈশরের স্মৃতিকে জাগ্রত করতেই এই নাট্য উৎসব দেখতে এসেছি ।
আয়োজক সংগঠন সারথীর প্রধান সম্পাদক জুলফিকার চঞ্চল জানালেন- বাংলাদেশের আবহমান নাট্যধারা ‘পালা’। একসময় গ্রামগঞ্জে এখনো প্রতিনিয়ত শত-শত পালা, জারি, যাত্রা মঞ্চস্থ হতো । সাধারণত গ্রামে পরিবেশনযোগ্য কাহিনিকেই ‘পালা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কাহিনির প্রাধান্য বা নির্ভরতা বিদ্যমান থাকে বলেই এ-শ্রেণির নাট্যকে ‘পালা’ বলে। বন্দনা, বর্ণনা, নাচ, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে পালা উপস্থাপিত হয়। বর্তমানে এসব অনুষ্ঠানের চর্চা নেই বললেই চলে ।কারণ এই পেশায় নিয়োজিত শিল্পীদের বর্তমানে কাজের মূল্যায়ন করা হয় না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এমন নাট্য উৎসবের আয়োজন করে করা হলে গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি এই খাত সংশ্লিষ্টরা নতুন প্রাণ ফিরে পাবে ।