তাসলিমুল হাসান সিয়াম,গাইবান্ধা প্রতিনিধি: এক সময়ের দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত গাইবান্ধা জেলায় দারিদ্র্যতার হার কমার সাথে সাথে বেড়েছে শিক্ষার হার । পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ গত কয়েক দশকে নিজেদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে ব্যস্ত । শিল্পের আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিক সহজলভ্যতার কারণে প্রত্যন্ত গ্রামেও গড়ে উঠেছে মাঝারি ও ছোট আকারের শিল্প কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষের পাশাপাশি বর্তমানে কাজ করছে নারীরা ।
সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নারী– এমন উদাহরণ এখন ভুরি ভুরি। এক সময় নারীদের ঘর থেকে বের হওয়াই কঠিন ছিল। এখন বদলে গেছে চিত্র। পেশাজীবনের নিম্ন থেকে উচ্চ সব পর্যায়ে এখন নারীর পদচারণা। পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে চলেছে নারী। অর্থনীতিতে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। বাণিজ্য, উৎপাদন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা– সব ক্ষেত্রে অদম্য নারী
তবে কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো নিপীড়নের শিকার হন, মুখোমুখি হন ব্যক্তিগত নানা বিড়ম্বনার। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেরও তাই সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা-বিড়ম্বনা কর্মজীবী নারীদের পিছু ছাড়ছে না।
নারীরা প্রতিবন্ধকতা ও বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার এই চিত্র প্রায় সর্বক্ষেত্রে। মফস্বল এলাকায় এই চিত্র যেন আরও বেশি। সম্প্রতি গাইবান্ধার কয়েকজন কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কথা বলে উঠে আসে এমন না জানা অনেক তথ্য।
লতা রাণী (২৫) কাজ করেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের একটি ফার্ণিচার তৈরির কারখানায় । সকাল ০৮ টা থেকে রাত ০৮ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে মাত্র ৩৫০ টাকা মজুরিতে ১২ ঘন্টা কাজ করে সে । অথচ একই কাজের জন্য একজন পুরুষ শ্রমিক মজুরি পায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ।
আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, শুধু মজুরি নয় সব দিক থেকেই বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকরা।
জমিতে ফাল্তনের তপ্ত দুপুরে অসহ্য দাবদাহের মধ্যে জমিতে কাজ করে চলেছেন সাহেরা বেগম। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে মেলে ৩০০ টাকা। বলেন দ্রব্য মুল্যের উদ্ধগতি কারনে কোনো রকমে বেঁচে থাকতেই এমন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। স্বামী আছে, কিন্তু একজনের আয়ে সংসার চলে না তাই নিজেও সংসারের হাল ধরেছেন।
তবে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি নারীর কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা।অনেক সময় তারা কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মী কিংবা বড় পদের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। চাকরি হারানোর ভয়ে এসব নির্যাতন অনেকে গোপনে সহ্য করছে। কর্মক্ষেত্রে কুদৃষ্টি, গায়ে ধাক্কা, অশ্লীল ইশারা, কুপ্রস্তাব, অশ্লীল কথাবার্তা—এ ধরনের অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয় নারীকে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে অফিসের বড় কর্মকর্তারা নানা অজুহাতে তাদের কক্ষে ডেকে পাঠান। আকার-ইঙ্গিতে নানা কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন। বুঝলে বিপদ, না বুঝলেও বিপদ। পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা নানা ধরনের গসিপ, কানাকানি, কথা লাগানো তো নিত্য ঘটনা। বস ও সহকর্মী দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয় অনেক কর্মজীবী নারীকে। ঘটে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা। তবে মানসম্মান কিংবা চাকরি হারানোর ভয়ে এসব অপরাধ মুখ বুজে সহ্য করতে হয় নারীদের ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাইবান্ধার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মচারী জানান, গতবছর তিনি কাজে যোগদান করার কিছু দিন পরেই ঐ প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র পুরুষ সহকর্মীর কুদৃষ্টিতে পড়ে । অন্যায় প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় তার উপর নেমে আসে মানসিক নির্যাতন । বাধ্য হয়ে চাকুরী ছেড়ে দিয়েছিলেন ঐ নারী ।
এছাড়া কর্মক্ষেত্রে রয়েছে নারীর নানা সীমাবদ্ধতা। গাইবান্ধার একটি ক্লিনিকে কাজ করেন ইশরাত জাহান (ছদ্মনাম)। তার মেয়ের বয়স ১ বছর। কাজে আসার সময় মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে আসেন তিনি। আসলে বাধ্য হন রেখে আসতে। কারণ তার অফিসে কোনো ডে কেয়ার সেন্টার নেই।
অফিস থেকে সাদিয়ার বাসা প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে। সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত । সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টা সন্তান থেকে দূরে থাকতে হয় তাকে। অফিসের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেও তার মন পড়ে থাকে সন্তানের কাছে।
গাইবান্ধা নারী মুক্তি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নিলুফা ইয়াসমিন শিল্পী জানান, আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রগুলো এখনো নারীবান্ধব নয়। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের যে সহযোগিতা প্রয়োজন তা একেবারেই করা হয়না। তিনি বলেন, ‘অনেকেই মুখে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্রের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেও অনেক জায়গায় নারীদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়।