তাসলিমুল হাসান সিয়াম, গাইবান্ধা প্রতিনিধি: উ গাইবান্ধাকে উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ঘিরে রেখেছে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা। এসব নদ নদীর বুকে জেগে উঠা প্রায় ১৬৫ টি স্থায়ী ও শতাধিক অস্থায়ী চরে বসবাস করছে জেলার প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ । ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এই জনপদের সব দুঃখ দুর্দশার খবর সমতলের মানুষ জানতে পারে না। চরবাসীরা তাই নীরবে নিভৃতে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করেই টিকে থাকছে । চরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানে নেই আধুনিক চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় চর থেকে মূল ভূখণ্ড কিংবা শহরে যেতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। ফলে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আগেই মারা যাচ্ছে অনেকে । বিশেষ করে গর্ভবতী নারী , শিশু ও বৃদ্ধরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।

দুই বছর আগে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার অন্তর্গত যমুনার দুর্গম কালুর চরের মর্মান্তিক ঘটনায় চরাঞ্চলের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে দেশ ব্যাপী ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয় ।

ঐ ঘটনায় জানা যায় প্রসব বেদনায় কাতর হেলেনা বেগম (২৫) কে নিয়ে তার স্বামী সুজা মন্ডল এবং ভাগ্নে আসাদুল “জলচৌকি” সাজিয়ে কাঠের তক্তা দড়ি দিয়ে ধরে কাঁধে নিয়ে তাকে তার ওপর বসিয়ে দেয় । এরপর তারা দুর্গম কালুরপাড়া চরের নিজ বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে হাসপাতালের দিকে রওনা হন।

কিন্তু তাদের চর থেকে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রায় ৪০ কিমি দূরে ছিল । হেলেনাকে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যেতে চার ঘণ্টা পার হওয়ায় তারা তাকে ফুলছড়ি টার্মিনালে একটি “ফার্মেসি ডাক্তারের” কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সঠিক সময়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছাতে না পারায় হেলেনা ও তার অনাগত সন্তান অবশেষে ফুলছড়ি লঞ্চ টার্মিনালে রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যান।

হেলেনা আক্তারের মতো এমন অনেক করুণ পরিণতির গল্প হয়তো ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নিয়মিত গণমাধ্যম আসে না । তবে বাস্তবতায় এই চিত্র আরও ভয়াবহ।জেলা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য বলছে , গাইবান্ধার চর এলাকায় ২ লাখ ৩১ হাজার মানুষের বসবাস। তবে চার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা জানান, প্রকৃত সংখ্যা সাড়ে চার লাখ।

মূল ভূখণ্ড থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ফুলছড়ি ইউনিয়নের কালুরপাড়ার ধাত্রী মাতভান বেগম (৪৫) বলেন, “এ এলাকায় কোনো স্বাস্থ্যকর্মী আসে না। প্রত্যাশিত মায়েরা জরুরি চিকিৎসা পান না।””এছাড়া, যেহেতু পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তারাও এখানে আসেন না, জনগণের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে কোন সচেতনতা নেই, এবং এর ফলে, অনেক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মহিলারা একাধিক সন্তান ধারণ করে।”

ফুলছড়ি উপজেলার গুপ্ত মনি চরের সোনাভানু বেগম বলেন ৩০ বছর ধরে আমি চরে ধাত্রী হিসেবে কাজ করছি। চর থেকে শহরে যাওয়ার পথ অনেক দূরে আর কষ্টকর , তাই বাড়িতে ঝুঁকি নিয়ে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করা হয় এতে অনেক সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা ও সন্তান দু’জনেই যারা যায় ।

কোচখালি চরে জোহরা বেগম বলেন, আমার তিন দিন বয়সী বাচ্চাটি খুব অসুস্থ, চরে কোন ডাক্তার নেই , বাধ্য হয়ে চার ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে গাইবান্ধা শহরে যেতে হবে । ডাক্তার দেখা শেষ করে আজকে বাড়ি ফিরতে পারব কিনা জানিনা কারন রাতের বেলা নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে আর ভাড়া নৌকায় খরচ কয়েকগুণ বেশি হয়

গাইবান্ধা জেলা পুষ্টি প্রোফাইল অনুসারে, চর এলাকার প্রায় ৬২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৮ বছর বয়সের আগে হয়, যেখানে প্রায় ৩৪ শতাংশ মহিলা ২০ বছরের আগে সন্তান ধারণ করে ফলে বাড়ছে মাতৃ মৃত্যুহার।

গাইবান্ধা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাত উপজেলায় ৩২০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে চর এলাকার ১১টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কোনো কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নেই, এছাড়া চর এলাকার বেশিরভাগ উপ-কেন্দ্রে অবকাঠামো এবং ডাক্তারের অভাব রয়েছে।

গাইবান্ধা পরিবার পরিকল্পনা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গাইবান্ধা জেলায় পরিবার কল্যাণ ভিজিটরের (এফডব্লিউভি) ৯৯টি পদের মধ্যে ৫৫টি শূন্য রয়েছে, এবং ৪১ টি বর্তমানে মূল ভূখণ্ডে কর্মরত রয়েছে। গত পাঁচ বছরে চর এলাকার জন্য কোনো এফডব্লিউভি নিয়োগ করা হয়নি।

জানতে চাইলে জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসের উপ-পরিচালক প্রসেনজিৎ প্রণয় মিশ্র বলেন, চর এলাকায় আমাদের কোনো ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র না থাকায় আমরা সেখানে কোনো এফডব্লিউভি নিয়োগ করতে পারছি না।

চরের বাসিন্দারা জানান, সপ্তাহে এক-দু’দিন কমিউনিটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের চিকিৎসক ক্লিনিকে আসেন। প্যারাসিটামল ও খাওয়ার স্যালাইন ছাড়া সেখানে অন্য ওষুধ তেমন পাওয়া যায় না। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় অবশ্য বলছে, কমিউনিটি ক্লিনিকে ২৭ ধরনের ওষুধ থাকার কথা। সরঞ্জাম হিসেবে রয়েছে একটি করে চেয়ার, টেবিল, আলমারি, বিপি মেশিন, ওজন মাপার মেশিন ও গ্লুকোমিটার।

শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা।তবে বাস্তব চিত্র একেবারেই আলাদা। জেলার বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা গেছে, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি তো আছেই, দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক বা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারকে (সিএইচসিপি) সপ্তাহে দু’দিনের বেশি পান না স্থানীয়রা।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দের পাড়া চর । স্থানীয়দের কাছে এটি চরের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ।ব্রহ্মপুত্র নদের বিচ্ছিন্ন এই চরে একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র রয়েছে। এখানে পুরুষরা স্বাস্থ্যসেবা নিলেও সমস্যায় পড়েছেন নারীরা। পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে নারীরা তাদের ঋতুকালীন সমস্যাসহ অনেক গোপন সমস্যার কথা লজ্জায় বলতে পারেন না।

এড়েন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক সদস্য আশরাফ আলী বলেন, ‘ডাক্তার দেখানো চরের মানুষের জন্য অনেক কষ্টের। বড় সমস্যা হলো, রোগীকে নদী পার হয়ে শহরে নিয়ে যাওয়া। আর যেসব চরে ক্লিনিক আছে, সেগুলোতেও সময়মতো ডাক্তার পাওয়া যায় না।’ ।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version