আরিফ শেখ, রংপুর প্রতিনিধিঃ
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হারিয়ারকুটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুমারেশ রায়ের বিরুদ্ধে দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য ঈদের বরাদ্দের চাল বিতরণ না করে তালা বদ্ধ করে রেখে নষ্ট করা ও ইদুর-মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে । বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর ঈদ উপলক্ষে বিশেষ বরাদ্দের চাল বিতরণ করে । দুস্থ-অসহায় মানুষদের এই চাল ঈদের আগেই বিতরণ করার নিয়ম রয়েছে । কিন্তু সেই চাল গত ৬ মাস ধরে তালা বন্ধ করে রেখে নষ্ট করে ফেলার সত্যতা পাওয়া গেছে ।
সরেজমিনে উপজেলার হারিয়ারকুটি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায় , বিট পুলিশিং অফিস কার্যালয় কক্ষে তালা ঝোলানো । জানালা সরিয়ে দেখা যায় , প্রায় ১ টনের বেশি চাল রয়েছে জমা সেখানে । সেই চালে চলছে ইদুরে-ইদুরের সার্কাস । চালের ওপরে জমেছে ইদুরের বিষ্ঠার ভাগারের আস্তর । নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় সব বস্তারই চাল ।
গ্রাম পুলিশ আবদুল কুদ্দুস প্রতিবেদককে দেখিয়ে বলেন, ‘এই রুমের ৫০ কেজি করে চালের সব গুলো বস্তা ঈদের চাল । বিতরণ করা হয়নি বলে এই ঘরে রাখা হয়েছে । তিনি আরো বলেন, চেয়ারম্যান এই ঘরের চাবি নিজের কাছেই রাখেন । কাউকে তিনি চাবি দেন না। এখানকার এক চিমটি চালও ধরতে দেন না । এসব চাল ৬ মাস আগের বরাদ্দ ঈদের চাল কিনা জানতে চাইলে তিনি জোর গলায় বলেন, আমরাই যদি না জানি তাহলে জানবে কে ? আরেক গ্রাম পুলিশ খয়রাত হোসেনও বলেন, বিট পুলিশিং কার্যালয় কক্ষের ৫০ কেজি চালের বস্তা গুলো ঈদের সময়ের বরাদ্দের চাল ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউপি সদস্য জানান, ‘ হারিয়ারকুটি ইউপি চেয়ারম্যান কুমারেশ রায় তার ব্যাক্তিগত পুকুরের মাছ চাষের খাদ্য হিসেবে সরকারি চাল ব্যাবহার করেছে । দীর্ঘদিন ধরে বিতরণ না করা ৬-৭ বস্তা পঁচা ও পোকা ধরা চাল চৌকিদার সরদার মহুবারের মাধ্যমে রাতের আধারে পুকুরে ঢেলে দিয়েছে । এছাড়াও একাধিক ইউপি সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন চেয়ারম্যানের গাফিলতির কারণে চাল গোডাউনে পরে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ও অনেক দরিদ্র মানুষ চাল পাচ্ছেনা। ফলে জনগনের তোপের মুখে পরতে হচ্ছে।
খাদ্য পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ নুরুন নবী বাবু জানান , হারিয়ারকুটি ইউনিয়নে ভিজিডির চাল ৩০ কেজির বস্তায় ৭৫৮ বস্তা চাল পাঠানো হয়। এছাড়াও গত বছরের ২৬ জুন জি আর প্রকল্পের ৩০ কেজি বস্তার ২০০ টি বস্তায় ৬ টন পাঠানো হয়েছে এবং ভিজিএফ প্রকল্পের ৫০ কেজি বস্তার ৬৪৫ বস্তায় ৩২টন ২৫০ কেজি চাল পাঠানো হয়েছে । হারিয়ারকুটি ইউনিয়ন পরিষদে বিতরণ না করে তালাবদ্ধ করে রাখা ৫০ কেজি চালের বস্তাগুলো কোন প্রকল্পের জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু আমরা শুধু ভিজিএফ প্রকল্পের ৫০ কেজি চালের বস্তা দিয়েছি সুতরাং বলাই যে ওই চালের বস্তা গুলো দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য ঈদের বরাদ্দের চাল অর্থাৎ ভিজিএফ প্রকল্পের । তিনি আরও বলেন , শ্রমিক আইন সংশোধনের কারনে গত বছরের জুন মাসের পরে থেকে আর কোন ৫০ কেজি বস্তা আমরা ব্যবহার করছিনা । জুনের পরে যত বস্তাই আমরা দিয়েছি তার সবই ৩০ কেজি বস্তা ।
এভাবে সরকারি চাল বিতরন না করে নষ্টের ব্যাপারে জানালে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আলতাফ হোসেন পরিষদে ছুটে আসেন । তার সামনেই গ্রাম পুলিশরা সাক্ষ্য দেন, বিতরণ না করা ৫০ কেজি বস্তা গুলো ঈদের সময়ের চাল । তালাবদ্ধ ঘরের জানালা দিয়ে চাল সংরক্ষণ করে রাখার এমন চিত্র দেখে পিআইও জানান, এসব নষ্ট চাল ও বস্তা সম্ববত জি আর প্রকল্পের চাল । কিন্তু যে প্রকল্পেরই হোক , এভাবে বিতরণ না করে নষ্ট করা কতটুকু যৌক্তিক বলে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা মোটেও ঠিক হয়নি। চালের বস্তাগুলো সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। । তবে এই চাল বিতরণ হয়েছে মর্মে জানতাম । চাল বিতরণ না হওয়ার ব্যাপারে তাদারকির গাফেলতি কেন করা হয়েছে প্রশ্নের জবাবে পিআইও আলতাফ জানান, বিতরণ উদ্বোধন করে চলে গিয়েছি । পরবর্তীতে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি । এই দায় আমার একার নয় ।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার ( পিআইও) কথা সঠিক নয় বলে উল্লেখ করে মুঠোফোনে কুমারেশ চেয়ারম্যান জানান, পরিষদে অন্য কোন প্রকল্পের চাল নেই । শুধু মাত্র ভিজিডির চাল রয়েছে । পিআইও’র দেওয়া তথ্য সঠিক নয় । জি আর কিংবা ঈদের সময়ের দেওয়া ভিজিএফের কোন চাল নেই । নষ্ট চাল পুকুরে ঢেলে দেওয়া বা ইদুরের খাওয়া ও ইদুরের বিষ্ঠার ভাগারের আস্তর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করে জানান , আমার পরিষদে যেসব চাল তালাবদ্ধ ঘরে রয়েছে সেসব অরক্ষিত ভাবে নেই ।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও কুমারেশ চেয়ারম্যানের বিপরীতধর্মী বক্তব্য এবং এখন পর্যন্ত বিতরণ না হওয়া চালগুলো নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ইউপি চেয়ারম্যান কোনো অবস্থাতেই চাল গুদামে মজুদ করে রাখতে পারেন না। তার ওপর গত ৬ মাস ধরে চালের বস্তা জমিয়ে রেখে নষ্ট করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের যেমন ক্ষতি করা হয়েছে তেমনি গরিব-দুস্থ-অসহায় মানুষের হক নষ্ট করা হয়েছে বলে মনে করছেন নাগরিকরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা উক্ত বিষয়ে বলেন, ‘এ বিষয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। সত্যতা পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জিআর বা ভিজিএফের চাল ৬ মাসেও বিতরণ না হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কি তার দায়ভার এড়াতে পারেন কিনা প্রশ্নের জবাবে জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন জানান, না দায়ভার এড়াতে পারেন না । যদি এমনটি হয়ে থাকে তাহলে সেটা হবে নিয়ম বহির্ভূত কাজ ।