যুগান্তরের প্রতিবেদন,
রাজধানীর কাওরান বাজার থেকে নাখালপাড়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার রেললাইনের দুপাশে গড়ে উঠেছে গাঁজার জমজমাট ‘হাট’। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে চলে বেচাকেনা। গাঁজা ক্রেতাদের বেশির ভাগই কাওরান বাজারকেন্দ্রিক রিকশা-ভ্যান চালক, ট্রাক-পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপার, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং উঠতি বয়সি তরুণ। বছরের পর বছর মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে কাওরান বাজারের রেললাইন এলাকা। রাজধানীর সবচেয়ে জমজমাট গাঁজার হাট হিসাবেও পরিচিত এ এলাকা। গাঁজা কেনার টাকা জোগাড়ে এ এলাকায় একাধিক ছিনতাই-হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে এ এলাকায় গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের কারবার চলে এলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেকটাই নিরুপায়। তারা বলছেন, এ এলাকায় মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে পুলিশের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে।
সূত্র জানায়, পুরো এলাকার গাঁজার কারবার নিয়ন্ত্রণ করে মন্টু ওরফে পেটকাটা মন্টু। সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে তিনি কারাগারে রয়েছেন। তবে কারাগার থেকেই গাঁজার কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রতি রাতে তার নিয়ন্ত্রিত প্রায় অর্ধশত কারবারি গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি করে থাকেন। চার-পাঁচজনের একেকটি গ্রুপ রেললাইনের নির্দিষ্ট এলাকায় মাদক বিক্রি করে। অনেক সময় হকারদের মতো ডেকে ডেকেও বিক্রি করে। গাঁজার প্রতি পুরিয়া বিক্রি হয় ১০০ টাকায়।
এদিকে মাদক কারবারি মন্টুর অন্যতম সহযোগী জোসনা বেগমকে শনিবার রাতে রেললাইনের শুঁটকি পট্টি এলাকা থেকে গাঁজাসহ গ্রেফতার করেছে তেজগাঁও থানা পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে ১২৫ পুরিয়া গাঁজা উদ্ধার করা হয়। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন যুগান্তরকে বলেন, মাদক কারবার ঠেকাতে ইতোমধ্যে ১০টি মাদক মামলার আসামি জোছনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রেললাইন এলাকা মাদকমুক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে এ এলাকায় কারবারিরা নানা ফন্দিতে কারবার চালাচ্ছে।
জানা গেছে, রেললাইনের এ এলাকাটির পশ্চিম পাশ তেজগাঁও থানার এবং পূর্বপাশ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার অধীনে। দুই থানা এলাকার মধ্যে পড়াতে কারবারিদের সুবিধাও হয়েছে। এক থানার পুলিশ ধাওয়া দিলে দৌড়ে অন্য থানা এলাকায় অবস্থান নেয় কারবারিরা।
সরজমিনে শনিবার রাত ১০টার দিকে কাওরান বাজার রেললাইন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, এ গাঁজার হাটে বিক্রেতাদের মধ্যে নারীও রয়েছেন। রেললাইনের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছেন বিক্রেতারা। তাদের হাতে বাজারের ব্যাগ। আর তার মধ্যেই গাঁজার পুরিয়া। রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়ার পথে ক্রেতারা গাঁজা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, বিক্রেতাদের বেশির ভাগই রেললাইনের পাশের বস্তির বাসিন্দা। মাঝেমধ্যেই পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলেই সটকে পড়েন তারা। দু-একজনকে ধরে নিয়ে গেলেও তারা জামিনে বের হয়ে ফের কারবার শুরু করেন।
কাওরান বাজার রেললাইনের পাশের মাছের আড়তের এক চা দোকানি যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর গাঁজার গন্ধে এ এলাকায় থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রির এ দৃশ্য দেখছেন।
এদিকে মাদকের টাকা জোগাড়ে ছিনতাইয়ের পথ বেছে নিয়েছেন অনেক মাদকসেবী। ফলে ছিনতাই-চুরিতে ডিএমপির অপরাধপ্রবণ এলাকার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তেজগাঁও বিভাগ। তেজগাঁওয়ের ফার্মগেট এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ১ জুলাই ভোরে পুলিশ কনস্টেবল মনিরুজ্জামান খুন হন। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের পর পুলিশ জানতে পারে তারা মাদকসেবী। রেললাইন এলাকায় তাদের বিচরণ।
গ্রেফতার জোসনা শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী : জোসনা বেগম কাওরান বাজার রেললাইন বস্তি এলাকার বাসিন্দা। তার স্বামীর নাম মনির হোসেন। জোসনা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ নারী মাদক ব্যবসায়ী। এ এলাকার মাদকের মূল নিয়ন্ত্রক মন্টু গ্রেফতারের পর তিনি এখন অন্যতম নিয়ন্ত্রক। সবজির ঝুড়ি নিয়ে ঘোরেন আর সুযোগ মতো ক্রেতাদের কাছে গাঁজা পৌঁছে দেন। জোসনার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ১০ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তেজগাঁও থানায় আটটি ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দুটি মামলা রয়েছে। প্রতিটি মামলায় তিনি জেলে গেছেন। প্রতিবারই জামিনে বের হয়ে আবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যান।