শীতের পরশ লেগেছে গ্রাম গঞ্জে। শহরগুলোও সিক্ত হতে শুরু করেছে শীতের কমল পরশে। এ বছর গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে পুড়েছে মানুষ। ফলে শীতের আগমনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে অনেকে। ইতিমধ্যেই গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে পড়েছে পিঠাপুলির ধুম। শহরের মোড়ে মোড়ে অনেকে সাজিয়ে বসেছে পিঠাপুলির পসরা। পোশাকের দোকানগুলোও সাজতে শুরু করেছে নানা রংবেরঙের শীত পোশাকে।
শীত কালকে কেন্দ্র করে এতসব আয়োজনের মধ্যেও বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ অকস্মাৎ আতঙ্কে কেঁপে উঠছে শীতের আগমনী বার্তায়। নাতিশীতোষ্ণ এ দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া এখন চরমভাবাপন্ন। ফলে গ্রীষ্মে মানুষকে পড়তে হচ্ছে অসহনীয় তাপে এবং শীতে জমতে হচ্ছে হিমশীতল হয়ে।প্রতি বছর তীব্র শীত মোকাবেলা করতে দেশের বড় একটি অংশের জীবনী শক্তি প্রায় ফুরিয়ে আসার উপক্রম হয়।
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহ গণনা অনুযায়ী গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ২১৯ জন এবং প্রায় ১৮ লাখ মানুষ বসবাস করে বস্তিতে।
জনশুমারির প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, খোদ রাজধানী ঢাকাতেই গৃহহীন ও বস্তিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যদিও ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত এক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে শুধু ঢাকা শহরে ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজার এবং বিভিন্ন সংস্থার মতে সারা দেশব্যাপী পথশিশুর সংখ্যাই ১০ থেকে ১৫ লক্ষ।
এই ছিন্নমূল মানুষগুলোর নেই কোন ঘরবাড়ি,নেই কোন স্থায়ী ঠিকানা। রেল স্টেশন, ফুটপাত, দোকান পাট এমনকি খোলা আকাশের নিচে মাথা গুঁজেই রাত পার করে তারা। তাছাড়াও আরো বড় একটি অংশ রয়েছে যাদের ঘরবাড়ি থাকলেও সেগুলো তীব্র শীত মোকাবেলার উপযোগী নয়। উপরন্তু তাদের কাছে নেই পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র। প্রতিবছর সারাদেশব্যাপী তীব্র শীতের কবলে পড়ে কত শতো অসহায় মানুষ বেঘোরে প্রাণ দেয় তার কোন পরিসংখ্যান নেই।
মূলত এই সকল মানুষদের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। প্রথমত সরকারকে,আসন্ন শীতে কত সংখ্যক মানুষের শীত মোকাবেলা করার সামর্থ সেই সমীক্ষা চালাতে হবে এবং সে অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে নতুন আশ্রয়ন প্রকল্প। ১৯৯৭ সাল থেকে আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় ৪১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫ জন মানুষের (আনুমানিক একটি পরিবারে পাঁচ জন ব্যক্তি হিসেবে) আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এই আবাসন প্রকল্প অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এখনো সারা দেশ ব্যাপী অনেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ সকল মানুষকে আসন্ন শীতে সুরক্ষিত রাখতে নেয়া প্রয়োজন একটি জোরালো পদক্ষেপ।
আসন্ন শীত তীব্র হতে শুরু করবে ডিসেম্বর মাস থেকেই, এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতো সংখ্যক মানুষকে স্থায়ীভাবে আশ্রয় প্রদান করা খুবই দুরুহ ব্যাপার। কাজেই বাংলাদেশ সরকারকে নিদেনপক্ষে স্বীতার্থ মানুষগুলো যেন তীব্র শীতে খোলা আকাশের নিচে বরফ শীতল হয়ে না জমে কোথাও আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে দ্রুততার সাথে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সহিত ধর্মীয় উপাসনালয় ও মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাত্রিকালীন আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে রাস্তায় বসবাসরত ছিন্নমূল মানুষদের জন্য বানাতে হবে স্বল্পস্থান দখল করে এমন অস্থায়ী কাঠের কুঠুরি। যার মধ্যে রাত্রিকালীন অবস্থান করে তারা তীব্র শীতে উষ্ণ থাকতে পারবে।
যাদের ঘরবাড়ি থাকা সত্ত্বেও; সেগুলো শীত মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত নয়। সেগুলোকে সরকারি অনুদানে মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে সকল শীতার্ত মানুষের শীত নিবারণের জন্য পর্যাপ্ত বস্ত্র। যাতে করে শীতকালে তারা ঘরে অবস্থান কালে থাকতে পারে উষ্ণ, নির্বিঘ্নে যেতে পারে কর্মস্থলে।
আমরা প্রতি বছর দেখি শীতকালের আগমনের সাথে সাথেই অনেক রাজনৈতিক দল ও সেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো শীতার্ত মানুষদের করুণাবসত পাতলা কম্বল দান করে থাকেন। আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হওয়ায় যেখানে বদ্ধ ঘরে পুরু কম্বল গায়ে চাপিয়েও শীত নিবারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, সেখানে খোলা আকাশের নিচে বা ঝুপড়ি ঘরে বসবাসরত মানুষকে একটি পাতলা কম্বল দান করা রীতিমত লোক দেখানো ও অযৌক্তিক।
আসন্ন তীব্র শীত থেকে আশ্রয়হীন, অসহায়, দুস্থ মানুষদের রক্ষা করতে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষদেরকে। তাঁদের প্রতি আমাদের আকুল চিত্তে নিবেদন, তাঁরা যেন আসন্ন শীতে শীতার্ত মানুষদের জন্য যথাযথ আশ্রয়স্থল ও গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করেন। যাতে করে আর একটি মানুষও তীব্র শীতে কষ্ট না পায় বা হিমশীতল ঠান্ডায় জমে অমানবিকভাবে মৃত্যুবরণ না করে।
লেখক: রবিউল আওয়াল পারভেজ
শিক্ষার্থী: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।