রুহুল আমিন,ডিমলা(নীলফামারী)

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলাকে গত বছর ২১ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে জেলার প্রথম ভূমিহীন ও গৃহহীন উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ থাকার আশ্রয় মিললো না পুরো সংসার জীবনে ভূমিহীন ৭০বছর বয়সী বিধবা সাহেরা খাতুনের। শুধু থাকার আশ্রয়েই নয় বরং মিলেনি কোনো বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা কিংবা অন্য কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সংসার জীবনের শুরু থেকেই মানুষের জমিতে থাকতে হয়েছে সাহেরা খাতুনকে। ৬৫ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে ৭০ বছর বয়সী সাহেরা খাতুন এখন কোথায় যাবেন? কি খাবেন? নেই মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই। সরিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যের জমিতে উঠানো ঘর। পরে চলে আসেন আরেক ভূমিহীন ভাতিজার বাড়ীতে। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের জন্য গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি টাকা চেয়ে বসেন। কিন্তু কোথায় পাবে টাকা? টাকা দিতে না পাড়ায় আজো ভাগ্যে জোটেনি সরকারের সেই কাঙ্খিত ঘর। আর জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) কার্ড হারিয়ে যাওয়ায় পায়নি বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা ও কোনো সরকারি সহায়তা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের দক্ষিণ ঝুনাগাছ চাপানি বালাপাড়া গ্রামে নবর উদ্দিনের বাড়ির উঠানে ছোট একটি টিনের খুপরি ঘরে শুয়ে আছে সাহেরা খাতুন ও ননদ আলিমন বেওয়া। প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে হাউমাউ করে কাঁদে সাহেরা খাতুন বললেন, আগত মানসির ভুইত ছিনুং (আগে মানুষের জমিতে বসবাস করেছি), হামার বাড়ি ওয়ালা মরার পর ওমার জায়গা নাকি নাই (আমার স্বামীর মৃত্যুর পরে জানি তার নিজস্ব কোন জায়গায় নেই), সেই তকন ওটে থাকি ওঠে দেইল (সেই তখনই ওখান থেকে আমাকে উঠিয়ে দিয়েছে)। মোর ননদ এটে (নবর উদ্দিনের জমিতে) থাকে এটে ধরি আসিল (আমার ননদ এখানে থাকে আমাকে নিয়ে আসছে)। মোর একান কাডও করি দেয় নাই আমাকে একটা কার্ড করে দেয়নি)। মোর কাড হেরাইছে সে তকন মোর নাকি কাড হইবে না (আমার জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেছে সেই তখন থেকে আমার কোন কার্ড হয়না)। চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছোত এতো বার গেনুং টাকা নাই বাড়িও পানুং না ( অতিরিক্ত টাকা দিতে অক্ষম হওয়ায় একাধিকবার জনপ্রতিনিধিদের কাছে ঘরের জন্য গিয়েও কাজ হয়নি)l সরকার কি ওমাক পাইসা নিবার কইছে (সরকার কি তাদের টাকা নিতে বলেছে)? মোর পোড়া কোপাল, মুই একনা ঘর পানুংনা! (আমি হতভাগা, আমি একটা ঘর পাইলাম না)।

সাহেরা খাতুনের ননদ অলিমন বেওয়া জানান, এখানে ৫-৬ বছর ধরে নবর উদ্দিন চাচার জমিতে আছি। আগে মাস্টার পাড়ায় ছিলাম, যেখানে ছিলাম সেখানে মানুষের জায়গা লাগে তাই উঠে দিয়েছে। একটা মানুষ আয় করে সাতজন মানুষ খেতে হয়।

সাহেরা খাতুনের ভাতিজার স্ত্রী ইসমেতারা জানান, স্বামী দিনমজুর বিভিন্ন এলাকায় জীবিকার তাগিদে কাজ করতে যায়। একজন কাজ করে সাতজন খাই। সরকারী ঘরের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে ছিলাম টাকা চায়, টাকা পাবো কই? যে অভাবী সংসার আবার ঘর কিনার টাকা।

একই পাড়ার মোফা নামের এক ব্যক্তি জানান, আগেও মানুষের জমিতে ছিল এখনও মানুষের জমিতে আছে। ওনার আইডি কার্ড হারিয়ে যাওয়ার কারণে কোনো সহায়তা পায় না। আমাদের পূর্ব পাশে যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর গুলো আছে অনেকে থাকে না। সেখানে তুলে দিলে ভালো হতো। মানুষের বাড়িতে খুঁজে খেয়ে চলছে জীবন।

রেজাউল ইসলাম নামের আরেকজন জানান, স্বামী-সন্তান নেই, আগেও মানুষের জমিতে ছিল এখন মানুষের জমিতে আছে। মানুষের বাড়িতে খুঁজে খাওয়া দাওয়া করে।

এ বিষয়ে ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একরামুল হক চৌধুরী বলেন, ওনারা অত্যন্ত মানবিক জীবন যাপন করছে। এছাড়াও আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরের নাম করে টাকা চাওয়া কোন সুযোগ নেই। কেননা এটা আমাদের জাতিসত্তাকে বিকশিত করতে ভূমিকা রাখছে। আর আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে বিধবা, বয়স্ক ভাতা এর প্রকল্প আসেনি আসলে করে দিতাম। তারা আমার প্রতিবেশী সমস্যা নেই এবারে একটি কার্ড করে দিবো। সেখানে দুইজন ভূমিহীন রয়েছে আমার জানা আছে।

এ প্রসঙ্গে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূর করা। আমাদের লোক পাঠিয়ে খবরাখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version