অনুপম পাল (বাঁশখালী প্রতিনিধি)
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ভারী বর্ষণের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পাদদেশ। ফলে যে কোনো মুহূর্তে পাহাড় ধসে ঘটতে পারে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা। পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলে ঝিরি-ছড়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে পানি। তারপরও বসবাসে ঝুঁকি জেনেও বাঁশখালী বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে তিন হাজারও বেশি পরিবার। তবে ওইসব পরিবারকে নিরাপদে সরে যেতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে মাইকিং করা হলেও তাতে বিন্দুমাত্র সায় দিচ্ছে না তারা। এতে পাহাড় ধসে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নের নাটমুড়া, সিন্নির ছড়া, সাধনপুর ইউনিয়নের বৈলগাঁও, বানীগ্রাম, লটমনি, জঙ্গল সাধনপুর, কালীপুর ইউনিয়নের জঙ্গল গুনাগরি, জঙ্গল কোকদণ্ডি, পালেগ্রাম, জঙ্গল কালীপুর, বৈলছড়ি ইউনিয়নের পূর্ব বৈলছড়ি, পূর্ব চেচুরিয়া, সরল ইউনিয়নের জঙ্গল পাইরাং, পৌরসভার পূর্ব জলদি, জঙ্গল জলদি, শিলকূপ ইউনিয়নের বামেরছড়া, ডানেরছড়া, ইকো পার্ক সংলগ্ন এলাকা, চাম্বল ইউনিয়নের পূর্ব চাম্বল, দুইল্লাঝিরি, জঙ্গল চাম্বল, শেখেরখীল ইউনিয়নের জঙ্গল নাপোড়া, পুইছড়ি ইউনিয়নের ভিলেজের পাড়া, জঙ্গল পুইছড়ি ও পূর্ব পুইঁছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় ৫০টিরও বেশি পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে ৮০ হাজার মানুষ। তাতে রয়েছে ২০ হাজারের অধিক পরিবার। তবে সেসব পরিবার থেকে ৩ হাজারের বেশি পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এসব পরিবারের ১০ হাজার মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এদিকে সরেজমিন পূর্ব পুঁইছড়ি পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ‘পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে একের পর এক বসতি। দুই পাহাড়ের মাঝখানের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে তৈরি হয়েছে অসংখ্য বসতঘর। ভারী বর্ষণেও এসব বসতঘরে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন সহস্রাধিক মানুষ। এদিকে পূর্ব পুইঁছড়ির পাহাড়ি এলাকার এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ পাড়া বসিরা বাড়ি। এখানে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি হয়েছে শতাধিক বসতঘর। তাতে বসবাস করছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। আর এসব ঘর খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দেখলে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়ে যাবে।
অন্যদিকে জঙ্গল পূঁইছড়ি লম্বা শিয়া এলাকার মাঝখানের রাস্তায় হ্যান্ডমাইক হাতে পাহাড় থেকে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে মাইকিং করছে দুই চৌকিদার। তবে তাতে বিন্দুমাত্র ভয় বা সায় নেই এই এলাকার মানুষের। তাদের দাবি, এর চেয়ে বেশি ভারী বর্ষণ আগে হয়েছে। এসব তো সামান্য মাত্র। কোনো ভয় নেই। পাহাড় থেকে সরে যাওয়ার দরকার নেই। তাদের দেখে মনে হলো, এসব ঝুঁকিপূর্ণ ঘর ধসে পড়ে গেলে তাদের কোনো ক্ষতিই হবে না।
পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীরা জানান, ‘কেউ আমাদের অসহায়ত্বের কথা শুনতে চাই না। আমরা ভূমিহীন মানুষ। পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও এসব পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছি। সরকার প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি শুরু হলেই মাইকিং করে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলে। তখন অনেকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়। কিন্তু দুর্ঘটনা কেটে গেলে আশ্বাস বাস্তবায়ন হয় না। প্রতি বছর বলা হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।’
জঙ্গল কালীপুরের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম, ‘আমরা যাব কই। আমাদের সব সম্বল তো পাহাড়েই। আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে তো খাবার-দাবার কিছু দেয় না। মরলে এখানে মরব। কোথাও যাব না।’
পুঁইছড়ি এলাকার আবুল কাসেম বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে উন্নয়নের নামে পাহাড় কেটে সেই মাটি দিয়ে বিভিন্ন এলাকার জমি ভরাট, নতুন সড়কে মাটি দেয়া, পুকুর ভরাট, মাটি বিক্রিসহ নানা কাজ করা হয়। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়। পরে বর্ষাকালে টানা বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে সেই পাহাড়ের কাটা অংশ ধসে গিয়ে ঘরের ওপর পড়ে। এতে যে কোনো সময় মাটিচাপা পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।’
সাধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান কেএম সালাহ উদ্দিন কামাল বলেন, ‘আমার ইউপির ৪০ হাজারের মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মানুষই পাহাড়ে বসবাস করে। তার মধ্যে ১ হাজার ২০০-এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার রয়েছে। বর্তমানে পূর্ব সাধনপুরে পাহাড়ি ঢলে বন্যাসহ পাহাড়ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করে বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয়ে যেতে বলেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘গত ৩ দিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এতে ধস ও প্রাণহানির শঙ্কা এড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। এ বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে কাজ করছে তারা।