আজকের বরেণ্য অভিনেতা আফজাল হোসনের ক্যারিয়ারে শুরুটা হয়েছিল একজন থিয়েটারকর্মী হিসেবে। চারুকলায় পড়ার সময় ঢাকা থিয়েটারের মাধ্যমে মঞ্চে কাজ শুরু করেন তিনি। সেই শুরুটাই যে একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে তা কে জানত! আজ বাংলাদেশের অভিনয় জগতের জীবন্ত ইতিহাস তিনি। অনুজদের আদর্শ।
সত্তর দশকের শেষ দিকে আফজাল হোসেন টেলিভিশন জগতে প্রবেশ করেন। আশির দশকে হয়ে ওঠেন টেলিভিশন নাটকের অনন্য এক নাম। সিনেমা তো ছিলোই। বিশেষ করে সিনেমার সেই ঝলমলে অধ্যায়ের পুরোটাই নিজ চোখে দেখেছেন তিনি। একসময় নিজে ছিলেন ‘সিনেমার পোকা’। সেটাও বলতে দ্বিধা করলেন না। ছোটবেলা থেকে কীভাবে তিনি সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন- এতো বছর পর এসে তা জানালেন তিনি।
তার কথায়, আমি ছিলাম সিনেমার পোকা। সত্তুর সালে ঢাকায় পা দিয়ে প্রথম রাতেই বলাকা সিনেমা হলে দেখি, রাজ্জাক-কবরী অভিনীত ‘দর্পচূর্ণ’। স্কুলে থাকতে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের ছবি কেটে কুটে এ্যালবাম বানিয়েছিলাম। রাজ্জাক-কবরী, আজিম-সুজাতা, নাদিম-শাবানা, শবনম, সুচন্দা, নাসিমা খান, রাণী, জেবা, ওয়াহিদ মুরাদ, মোহাম্মদ আলী এমনকি উল্টোরথের পাতা থেকে উত্তম-সুচিত্রা, দিলীপ-কুমার, রাজ কাপুর, দেবানন্দ, বৈজয়ন্তিমালা, মধুবালাদের ছবিও সে এ্যালবামের সম্পদ ছিল।
কম বয়সে সিনেমা দেখা, গল্পের বই পড়া খারাপ কাজ বলে বিবেচনা করা হতো। আব্বা আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে একটাই ছবি দেখিয়েছিলেন- নবাব সিরাজউদ্দৌলা। দেখানোর কারণ তা থেকে ইতিহাস জানা, শেখা হবে- সেটা ঐতিহাসিক ছবি।
ছোটবেলার সেইসব স্মৃতি আজও নাড়া দেয় তাকে। বললেন, আমার নানাবাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। সীমান্তের এপার ওপারের মানুষদের ধ্যান ধারণায় পার্থক্য অনেক। ছোট একটা লাইব্রেরি ছিল নানা বাড়ির দোতলার চিলেকোঠায়। সেখানে গল্প উপন্যাস- সিনেমা, সাহিত্য পত্রিকা সবই ছিল। নানাবাড়ির দেয়ালে মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু, নেতাজী সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাঁধানো ছবি ঝোলানো থাকতে দেখেছি। সে বাড়িতে সিনেমা দেখা, গল্প উপন্যাস পড়া অত খারাপ কাজ বলে মনে করা হতোনা।
ঢাকায় এসেই নাকি তার কপাল খুলে গেছে। জানালেন, ‘ঢাকায় এসে আমার কপাল খুলে গেলো। তখন এই শহরে ইংরেজি বাংলা আর উর্দু ভাষার সিনেমা চলে। ফাঁক পেলেই এ হল ও হলে ঘুরে বেড়াতাম। সেকালে মন মজানো সৌরভে ম ম করতো হলগুলো। আসিতেছে, চলিতেছে লেখা বাক্সের মধ্যে কোন ছবি আসবে আর চলছে যে ছবি উভয়ের স্থিরচিত্র প্রদর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা হতো। দর্শক কাঁচ লাগানো বাক্সের সামনে ভিড় করে ছবির উপভোগ করতেন। তখন সপ্তাহে কমপক্ষে তিনটি সিনেমা না দেখলে পেটের ভাত হজম হতোনা। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। থাকতাম বাংলামোটর (তখন পাক মোটর) জহুরা মার্কেটের পিছনে সাতক্ষীরা মেসে। রোজ বিকালে আর্ট কলেজ থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে সামনের ইউসুফ কনফেকশনারি থেকে কিছু একটা খাবার কিনে নিয়ে পূর্বদিকের ঢাল বেয়ে নেমে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম এফডিসির দিকে। তখন সেই গেটের সামনে দেখতাম উপচে পড়া মানুষের ভীড়। ভিড় করে থাকা সব মানুষের মনে একটাই আশা, আহা যদি একবার ভিতরে ঢোকা যেতো! সবার কাছে সেটা ছিল স্বপ্নপুরী। সিনেমার স্বপ্ন তৈরির সাধ্য ছিল বলে মানুষের মনে তা নিয়ে আগ্রহ, কৌতূহল ছিলো বিশেষ।
এই অভিনেতার ভাষ্য, একসময় কেমন ছিল সিনেমা- বোঝাতে এতো বিস্তারিত বলা। সিনেমার জন্য মানুষের টান, উন্মাদনা কতটা ছিলো সচক্ষে সবই দেখা। আবার উন্মাদনা, আকর্ষণ নানা কারণে কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় ঠেকতেও দেখেছি। আকাশ থেকে পাতালে ছিটকে পড়ার মতো বেদনাদায়ক ঘটনা। উত্থান ও পতনের ছন্দেই চলে জগৎ ও জীবন। সেই নিয়মে ২০২৩এর মাঝামাঝি এসে অনুভব হচ্ছে চলচ্চিত্রের হারানো গৌরব আবার ফিরছে।
বহুদিন পর সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। ঈদ উপলক্ষে পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। তার মধ্যে তিনটি সিনেমা নিয়ে খুব চর্চ্চা হচ্ছে। এমনটা অনেককাল পর ঘটতে দেখেছি। দেখেছি সিনেমা দেখার জন্য সকল শ্রেণীর মানুষের হুড়োহুড়ি। এমনই ছিল। দর্শকের মুখ ফিরিয়ে নেয়া, এমন সিনেমাবিমুখ হওয়ার কারণ- যারা ভালো সিনেমা বানাতেন একে একে সবাই একসময় সরে পড়লেন। জায়গা ফাঁকা থাকেনা, পরবর্তীতে যেমন সিনেমা নির্মিত হতে থাকলো- সেসকল সিনেমা থেকে বিরাট সংখ্যক দর্শক আগ্রহ সরিয়ে নিতে বাধ্য হন।
তারপর লম্বা সময় ধরে দর্শককে বিচ্ছিন্নতার জন্য, সিনেমা দেখার প্রতি অনীহার জন্য দোষারোপ করা হয়েছে। প্রিয়তমা, প্রহেলিকা আর সুড়ঙ্গ সিনেমা নিয়ে দর্শকের ব্যাপক আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, মন্দ উদ্দেশ্যের সিনেমা ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর দূরত্ব রচনা করেছিল- সদিচ্ছায় নির্মিত সিনেমাই আবার দর্শকদের টেনে আনছে সিনেমা হলে।
সবশেষে তিনি বলেন, মন্দের সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন দর্শক। এখন উৎসাহ, আনন্দপ্রকাশ করে জানিয়ে দিচ্ছেন, ভালোর সঙ্গে তাঁরা ছিলেন, আছেন, থাকবেন। দর্শক সিনেমার পোকা হতে চান- এমন ইচ্ছার প্রতি সমীহ দেখানো খুব জরুরী। আরও জরুরী হচ্ছে- তাঁদেরকে বোকা না ভাবা।