ঢালিউডে এমন জোয়ার আগেও এসেছে বহুবার, তবে গতি ও উচ্চতা এতটা ছিল না। ঈদ উৎসব শুরুর আগে থেকে যে জোয়ার শুরু হয়েছে, তৃতীয় দিন পেরিয়েও সেটি কমেনি এতটুকু। বরং বেড়েছে কয়েক ধাপ। সূত্র বলছে, ঈদে মুক্তি পাওয়া সব ছবিই প্রথম তিন দিনে (২৯ জুন-১ জুলাই) প্রায় হাউজফুল গেছে। হল মালিকদের প্রত্যাশা, এ ধারাবাহিকতা থাকবে চলতি সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত।
তবে এরমধ্যে উঠেছে নতুন জোয়ার। এটা অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের। এই উৎসবে ঢালিউডে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ হয়ে আছে শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ ও আফরান নিশোর ‘সুড়ঙ্গ’। অনেকটা স্বতন্ত্র অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে মাহফুজ আহমেদের ‘প্রহেলিকা’। নিরবের ‘ক্যাসিনো’ আর অপু বিশ্বাসের ‘লালশাড়ি’ আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে রয়েছে ময়দানে।
তবে ঈদের দ্বিতীয় দিনের (৩০ জুন) মাথায় মূল অভিযোগটা ওঠে দেশের সর্বাধিক হলে মুক্তি পাওয়া ‘প্রিয়তমা’ শিবির থেকে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মাল্টিপ্লেক্সগুলো নাকি ‘ষড়যন্ত্র’ করেই টিকিটের চাহিদা সত্ত্বেও শো বাড়াচ্ছে না ‘প্রিয়তমা’র। অথচ দ্বিতীয় দিনেই রায়হান রাফী ঘোষণা দেন, দর্শক চাপে ‘সুড়ঙ্গ’র শো বাড়ানো হয়েছে এক লাফে ১৫টি (১৮টি থেকে বেড়ে হলো ৩৩টি)!
যদিও এ বিষয়ে স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ আলাদা করে কোনও মন্তব্য প্রকাশ করতে সম্মত নয়। তবে অফ দ্য রেকর্ড এটুকু জানা গেছে, ‘প্রিয়তমা’র অভিযোগ ডাহা মিথ্যা কথা। দিন শেষে স্টার সিনেপ্লেক্স একটি শতভাগ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যে সিনেমার চাহিদা যত বেশি, তার শো তত বাড়বে। যার চাহিদা কমবে, তার শো সংখ্যাও নামবে। এটাই নিয়ম। যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ ‘প্রিয়তমা’ টিম। এমন অভিযোগের বিপরীতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে ‘সুড়ঙ্গ’ বাহিনীও। প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগতা জানালেন নির্মাতা রায়হান রাফী। বললেন, এসব সস্তা বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না।
তবে শো সংখ্যা ছাপিয়ে তৃতীয় দিনে (১ জুলাই) এসে নতুন আগুন ধরালো একই টিম; মানে ‘প্রিয়তমা’। এবার নির্মাতা হিমেল আশরাফ সরাসরি মাঠে নামলেন। তিনি জানান, ‘প্রিয়তমা’র বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে; যা প্রেক্ষাগৃহ থেকে মুঠোফোনে ধারণ করা হয়েছে। এজন্য সাইবার ক্রাইমের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি।
হুমকি দিয়ে হিমেল বলেন, ‘হল থেকে ভিডিও করে যারা অনলাইনে দিচ্ছেন, তাদের তালিকা সাইবার ক্রাইমে দেওয়া হয়েছে। যদি বিপদে পড়তে না চান, তবে হল থেকে ধারণ করা সিনেমার ভিডিওগুলো নামিয়ে ফেলুন। প্রায় ২২ হাজার ফুটেজ আমরা ডিলিট করেছি এবং করছি।’
মজার তথ্য হলো, অনেকেই বলছেন ‘প্রিয়তমা’র গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজগুলো ফেসবুক-ইউটিউবে প্রকাশ করছেন মূলত শাকিবিয়ানরাই। এটা মূলত তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কারণ, হলে বসে সিনেমার দরকারি মুহূর্ত ভিডিও করে সেটি প্রকাশ করা যে গুরুতর অপরাধ, সেটিও তাদের বেশিরভাগই অবগত নন! তাই প্রশ্ন থেকে যায়, ‘প্রিয়তমা’ টিম সিনেমা হলে দর্শকদের ভিডিও করার সুযোগ কেন দিলো। কেন অন্য ছবিগুলোর মতো এ বিষয়ে নজর দেওয়া হয়নি আগেই।
যদিও ‘প্রিয়তমা’ টিম এই ফুটেজ প্রচারের পেছনে দায়ী করতে চাইছে ‘সুড়ঙ্গ’ বাহিনীকে! তারা বলতে চাইছেন, একটি পক্ষ টাকা দিয়ে এসব ফুটেজ প্রকাশ এবং নেতিবাচক ভিডিও করাচ্ছে। আরও মজার বিষয়, হিমেল আশরাফের এমন অভিযোগ বা হুমকির একঘণ্টা পর একই অভিযোগ খুব মিষ্টি সুরে তুলেছেন ‘সুড়ঙ্গ’ নায়িকা তমা মির্জাও।
প্রথমে শোনা যাক হিমেল আশরাফের পুরো প্রতিক্রিয়াটি, ‘সিনেমা একটি প্রোডাক্ট। টাকার বিনিময়ে আপনি কোনও একটা সিনেমার প্রশংসা, সুনাম করতেই পারেন (যদিও আমি মনে করি সিনেমার দম থাকলে এসবের কোনও দরকার পড়ে না)। কেউ যদি আপনাকে টাকা দেয় আপনি সারা দিন সেই সিনেমার মিথ্যা বা সত্য গুণগান করতে থাকেন, নো প্রবলেম। কিন্তু আপনি একটা সিনেমা থেকে টাকা খেয়ে অন্য সিনেমার মিথ্যা বদনাম করবেন, অপপ্রচার করবেন, খারাপ রিভিউ দেবেন, সেটা কিন্তু অন্যায়, অপরাধ।’
ক্ষুব্ধ নির্মাতা আরও বলেন, ‘কোনও সিনেমাই ত্রুটিমুক্ত নয়, আপনি সিনেমা দেখেন, ভালো না লাগলে অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। কিন্তু যদি টাকা খেয়ে সিনেমার বদনাম করেন তাহলে আপনি একটা অসৎ মানুষ, আপনার বিচার হবে, অবশ্যই হবে। প্রকৃতিই আপনার বিচার করবে। আর যারা এসব করায় তারাও সমান অপরাধী, অসৎ, বিবেকহীন এবং পরাজিত অমানুষ।’
স্পষ্ট, তরুণ নির্মাতা হিমেল আশরাফ অল্পতেই খেই হারিয়ে ফেলছেন! বিপরীতে পরীক্ষিত নির্মাতা রায়হান রাফী, তুখোড় অভিনেতা আফরান নিশো বেশ চুপচাপ, অনেকটা দর্শকের আসনে বসে আছেন। তবে ‘প্রিয়তমা’কে আঘাত না করেই বেশ মিষ্টি ভাষায় একটি তুমুল প্রতিক্রিয়া জানালেন ‘সুড়ঙ্গ’ নায়িকা তমা মির্জা। হিমেল আশরাফের প্রতিক্রিয়ার এক ঘণ্টার মাথায় তমা ভক্ত-দর্শকদের প্রতি বললেন, ‘‘তোমরা যে ‘সুড়ঙ্গ’ মুভির রিভিউর নামে মুভির মেইন মেইন পার্ট-এর ভিডিও করে এখানে ওখানে ছেড়ে দিচ্ছ, এটা কিন্তু ঠিক না। ‘ভাইয়ারা’ তোমাদের পেজ-এ ঢুকলে কিন্তু সব বুঝতেছি আমরা। এটা ভেবো না যে ‘সুড়ঙ্গ’ টিম এগুলো মনিটর করছে না। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বার্থে ‘সেটা যে মুভিরই হোক’ এই অমানবিক কাজটা কইরো না প্লিজ।’’
পরে রবিবার (২ জুলাই) ‘সুড়ঙ্গ’ কর্তৃপক্ষ জানায়, সোমবার (৩ জুলাই) বিকাল তিনটায় স্টার সিনেপ্লেক্স এসকেএস টাওয়ার মহাখালী শাখায় সিনেমার পাইরেসি ও অপপ্রচার নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবে পুরো টিম।
সব মিলিয়ে, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ নিয়ে শাকিব আর আফরান বাহিনী দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি অবস্থানে। এবং এটা ঢালিউডের জন্য মঙ্গল বার্তা বহন করে। কিন্তু এ দুজনের মাঝে দারুণ একটি অবস্থান নিয়ে আছেন মাহফুজ আহমেদ, সেটিও লক্ষণীয় বিষয়। যিনি ঈদের প্রথম দুদিন গ্রামের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে তৃতীয় দিন (১ জুলাই) বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন ঢাকার প্রতিটি মাল্টিপ্লেক্সে। জড়িয়ে ধরেছেন বয়োবৃদ্ধ দর্শকদের, কোলে তুলে নিয়েছেন শিশুদের। গল্প-আড্ডায় মেতে ছিলেন সারাক্ষণ। লক্ষণীয় তথ্য, ‘প্রহেলিকা’ দেখে বের হওয়া কোনও দর্শককেই একটি নেতিবাচক মন্তব্যও করতে দেখা যায়নি। অন্তত সোশ্যাল হ্যান্ডেলে এমন কিছু এখনও আসেনি- পেইড অথবা নন-পেইড।
চতুর্থ দিনে (২ জুলাই) এসে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ‘প্রিয়তমা’র দিকে। ‘সুড়ঙ্গ’ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ‘প্রিয়তমা’ গ্রুপ মাঠে নেমেছে অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে তাদের ছবিটিকে দমিয়ে দিতে। এরমধ্যে দেখা গেছে একটি রিভিউ ভাইরাল হলো। যেখানে সিনেমা দেখে হল থেকে বেরিয়ে বেশ ক’জন দর্শক চরম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন ‘সুড়ঙ্গ’ নিয়ে। যেখানে বারবার বলা হচ্ছে, পরিবারের সদস্যরা এ ছবি দেখতে এসে বিব্রত হয়েছেন। বলা হচ্ছে, এই ছবির মাধ্যমে নারীদের অবদমন করা হয়েছে ইত্যাদি, যা ‘সুড়ঙ্গ’ টিমের জন্য ভয়ংকর বার্তা।
অভিযোগ উঠেছে, এই কাজটি করানো হচ্ছে ‘প্রিয়তমা’র অর্থায়নে! ‘সুড়ঙ্গ’ টিমের প্রতি একই অলিখিত অভিযোগ তোলা আছে ‘প্রিয়তমা’র পক্ষ থেকে! মাঝে ‘প্রহেলিকা’ নির্মাতাও অভিযোগের আঙুল তুলতে ভুললেন না। সম্ভবত তিনিও ট্রেন্ড মিস করতে চাননি। তৃতীয় দিন রাতে বললেন, ‘চক্রান্ত করে ভালো কিছু দাবায়ে রাখা যায় না। কারণ, ওপরে একজন আছেন, তার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। ধন্যবাদ সকল দর্শকদের। যারা তিন দিন হাউজফুল করেছেন এই বৃষ্টিতে ভিজে।’
যদিও চক্রান্তের বিষয়টি স্পষ্ট করেননি নির্মাতা। সম্ভবত শো কম পেয়েছে ‘প্রহেলিকা’। কিন্তু সেই চক্রান্ত কি তবে শাকিব খান ও আফরান নিশো দুই বাহিনী মিলেই করলো! জটিল সমীকরণ।
তবে বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন, শাকিব-নিশোর চলমান যুদ্ধংদেহী মহড়া ফুরাবে সপ্তাহের মাথায়। কারণ, দুই তারকার ভক্তবাহিনী যতটা বিস্তৃত, তাদের কনটেন্ট দুটি ততটা সমৃদ্ধ নয়; সঙ্গে চলছে অন্তর্জালে ধারাবাহিক ‘কাইজ্জা’। এটা দুই টিমের সদস্যদেরই অব দ্য রেকর্ড প্রতিক্রিয়া। ফলে, ঈদের ছবির এই যুদ্ধে, শাকিব-নিশোর অদূরে লম্বা রেসের ঘোড়ার পিঠে চুপচাপ বসে মুচকি হাসছেন অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ। কারণ, ছবিগুলো মুক্তির আগেই এই অভিনেতা প্রকাশ্যে আহ্বান করেছেন ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে প্রতিটি ছবির পাশে সবাইকে দাঁড়ানোর জন্য। যদিও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন দেখলেন ৮ বছর বিরতির পর ফিরে।
মূল দুই পক্ষের চলমান ‘কাইজ্জা’র বিপরীতে নীরব মাহফুজ আহমেদ প্রমাণ করলেও করতে পারেন, পুরান চাল ভাতে বাড়ে। অথবা দিন শেষে, গলার জোর নয়, গল্পটাই টিকে থাকে।