ওড়িশার বালেশ্বরে আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, শনিবার ভোর পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৩৩। আহত ৯০০ জনেরও বেশি। অন্য দিকে, ওড়িশার দমকল বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল সুধাংশু ষড়ঙ্গী জানিয়েছেন, শনিবার ভোর পর্যন্ত অন্তত ১২০টিরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীদেরও আশঙ্কা, উদ্ধারকাজ যত এগোবে, নিহত এবং আহতের সংখ্যা আরও বাড়বে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে অনেক যাত্রী আটকে রয়েছেন বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন। গভীর রাতে ট্রেনের দরজা ভেঙে ও গ্যাস কাটারের সাহায্যে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। নামানো হয়েছে সেনাবাহিনীকেও। দুর্ঘটনা এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব-সহ রেলের পদস্থ অফিসারেরা। রেল উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তবে রেলের দাবি, শনিবার ভোর পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৮৮। আহত ৬০০ জনেরও বেশি।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা থেকে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছেন ঘটনাস্থলে। অসমর্থিত সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে মমতা ঘটনাস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শনিবার সকালে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে তিনি হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। ফিরে আসবেন শনিবারেই। শুক্রবার রাতে হাওড়া এবং শালিমার স্টেশনে ভিড় করেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রীদের উদ্বিগ্ন পরিজনেরা। দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারবর্গকে এককালীন ১০ লক্ষ টাকা, গুরুতর আহতদের ২ লক্ষ টাকা এবং অল্প আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
তবে দুর্ঘটনা কী করে ঘটেছে, তার একাধিক বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় একটি সূত্রের দাবি, প্রথমে করমণ্ডল এক্সপ্রেসই তীব্র গতিতে গিয়ে ধাক্কা মারে একই লাইনে আগে আগে চলতে-থাকা একটি মালগাড়ির পিছনে। দুর্ঘটনার অভিঘাতে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি মালগাড়ির উপরে উঠে যায়। ২৩টি কামরার মধ্যে ১৫টি কামরা লাইন থেকে ছিটকে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে ও নয়ানজুলিতে। সেই লাইন দিয়ে তখন আসছিল ডাউন বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত কামরাগুলি গিয়ে পড়ে ডাউন লাইনের উপর। বেঙ্গালুরু-হাওড়া ডাউন ট্রেনটি সেই বেলাইন কামরাগুলির উপর এসে পড়ে। হাওড়াগামী সেই ট্রেনটিরও দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়। তবে ভোর পর্যন্ত যে ৮৮ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে রেল, তাঁরা প্রত্যেকেই করমণ্ডলের যাত্রী বলে জানানো হয়েছে।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের এস ৪ কামরায় ছিলেন ক্যানিংয়ের বাসিন্দা প্রশান্ত মণ্ডল এবং তাঁর ভাইপো কৃষ্ণপদ মণ্ডল। পেশায় রাজমিস্ত্রি প্রশান্ত যাচ্ছিলেন তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তূরে। কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচেছেন প্রশান্ত। শুধু পায়ে সামান্য চোট লেগেছে তাঁর। ঘটনাস্থল থেকে ফোনে তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘উল্টে-পড়া কামরা থেকে বেরিয়ে প্রথমে একটা রেলগেট দেখতে পাই। সেখানে এক জন পুলিশ ছিল। সে বলল, সিগন্যাল না পেয়ে মালগাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। করমণ্ডল সজোরে গিয়ে মালগাড়ির পিছনে ধাক্কা মারে।’’ করমণ্ডলের ইঞ্জিনটি যে ভাবে মালগাড়ির উপর উঠে পড়েছে, তা পিছন থেকে সরাসরি ধাক্কা মারলেই সম্ভব। প্রত্যক্ষদর্শী ওই পুলিশকর্মীর বয়ানও তেমনই বলছে।
আবার রেলের একটি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, মালগাড়ির সঙ্গে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কোনও সংঘর্ষ হয়নি। কোনও কারণে প্রথমে আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়। সেটি গিয়ে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে। সেই লাইন ধরে তখন আসছিল ডাউন বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। সেটি এসে ধাক্কা মারে করমণ্ডলের লাইনচ্যুত কামরাগুলিকে। সেই ধাক্কার অভিঘাতে করমণ্ডলের ইঞ্জিন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে-থাকা মালগাড়ির উপরে উঠে যায়।
রেল সূত্রে খবর, শুক্রবার সন্ধ্যায় মালগাড়িটি খড়্গপুর থেকে ছাড়ে। তার ১৩ মিনিট পরে খড়্গপুর স্টেশন ছাড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। মালগাড়ি এবং করমণ্ডল এক্সপ্রেস একই লাইনে চলছিল ১৩ মিনিটের ব্যবধানে। বালেশ্বর স্টেশন ছাড়িয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার যাওয়ার পরে দুর্ঘটনাটি ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রাথমিক অনুমান, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের চালক যে ওই ১৩ মিনিটের গতির ব্যবধান কমিয়ে ফেলেছেন, তা তিনি বুঝতে পারেননি। তার কারণ সিগন্যালের ত্রুটি হতে পারে। হতে পারে সিগন্যাল দেওয়া হলেও চালক তা খেয়াল করেননি। অথবা একই লাইনে যে মালগাড়িটি রয়েছে, তা তিনি খেয়াল করেননি।
তবে দুর্ঘটনার কোনও কারণই নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। বিভাগীয় তদন্ত শুরু হলে এর সঠিক কারণ জানা যাবে। আপাতত অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে হতাহতদের উদ্ধারে এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে লাইনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উপর। কারণ, ওই দুর্ঘটনার ফলে হাওড়া থেকে দক্ষিণ ভারতগামী সমস্ত ট্রেন শুক্রবার বাতিল করতে হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে শনিবারের কিছু ট্রেনও। খড়্গপুর থেকেও ওড়িশাগামী কিছু ট্রেন বাতিল হয়েছে।
রেল মন্ত্রকের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা বলেন, ‘‘সন্ধ্যা ৭টা চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১০ থেকে ১২টি কামরা বালেশ্বরের কাছে বেলাইন হয়। সেই কামরাগুলি ছিটকে পড়ে পাশের লাইনে। সেই লাইনে হাওড়াগামী বেঙ্গালুরু-হাওড়া এক্সপ্রেস আসছিল। সেই ট্রেনটির সঙ্গে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ছিটকে-পড়া কামরাগুলির সংঘর্ষ হয়। এতে হাওড়াগামী ট্রেনটিরও দু’টি কামরা বেলাইন হয়ে যায়।’’
সংবাদ সংস্থা পিটিআই, আনন্দবাজার অনলাইন