বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদে আগামী (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে সকালে সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে খসড়া বাজেটের অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে মোট ব্যয় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর ঘাটতি (অনুদানসহ) ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা এবং অনুদান ছাড়া ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে-‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।’
রাজস্ব আহরণে সর্বোচ্চ জোর দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি রাজস্ব আহরণে সব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই।’ রিটার্ন দাখিল সহজীকরণ ও করনেট সম্প্রসারণ, কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণ, স্বয়ংক্রিয় ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে ভ্যাট আদায় সহায়ক ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন ও সম্প্রসারণ, অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো হবে।
বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয় : সরকার আয় বাড়াতে নজর দিয়েছে ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, সম্পূরক ও সুনির্দিষ্ট শুল্কের ওপর। ক্ষেত্র বিশেষ নতুন ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে সর্বনিম্ন ২ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি মোবাইল ফোন, আমদানিকৃত এলপি গ্যাস, চশমার ফ্রেম ও বাইসাইকেলের দাম বাড়বে। এছাড়া গৃহস্থালিসামগ্রীর ক্ষেত্রে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালিসামগ্রী উৎপাদনে ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই হারে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালিসামগ্রী ও তৈজসপত্রের (হাঁড়ি-পাতিল, থালাবাসন) ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু/পকেট টিস্যু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। পাশাপাশি মাইক্রোওয়েভ ওভেন এবং উচ্চ সিসির গাড়িতে খরচ বাড়বে। এছাড়া নির্মাণ ব্যয় বাড়বে। বিশেষ করে সিমেন্ট, শিরিষ কাগজ, আঠা বা গ্লুসহ খাদ্যসামগ্রী মাছের টুকরা, চিজ ও দই, চা-কফিমেট, গ্যাস লাইটারের দাম বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বিরিয়ানি-তেহারির প্রধান উপকরণ বাসমতি চাল আমদানিতে ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে চালের দাম বাড়বে। সুস্বাস্থ্যের জন্য বাদাম-খেজুর খান অনেকে। বাজেটে তাজা ও শুকনা খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। দেশে বাদাম চাষকে উৎসাহিত করতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করা হচ্ছে। সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মোবাইল ফোনকে বিলাসী পণ্য বিবেচনায় নিয়ে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি আছে, সেখানে ২ শতাংশ, সংযোজন পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে আগে রিটার্ন জমা দেওয়া গেলেও আগামী দিনে স্লিপ (প্রাপ্তিস্বীকারপত্র) পেতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে সঞ্চয়পত্র কেনা এবং ব্যাংক ঋণ নেওয়া যাবে না। ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, বাড়ির নকশা অনুমোদনসহ সব মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না। তবে মূল্যস্ফীতি বিবেচানায় কিছুটা স্বস্তি দিয়েছেন ব্যক্তি শ্রেণির আয়কর সীমায়। পুরুষদের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা এবং নারী ও ৬৫-ঊর্ধ্ব চার লাখ টাকা, প্রতিবন্ধীর ৪ লাখ ৭৫ হাজার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া নন লিস্টেট কোম্পানির এক ব্যক্তি কোম্পানির কর হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ, আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হলে তালিকাভুক্তি কোম্পানির কর হার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে নামিয়ে ২০ শতাংশ। তবে করপোরেট কর হার অপরিবর্তিত রয়েছে।
নানামুখী চাপের মধ্যে দাঁড়িয়েও ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার প্রত্যাশা রেখে ভোটের আগে রেকর্ড ঘাটতির যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তার ১৭ শতাংশের বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জোগাড় করতে হবে। ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন এর মধ্যে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। যা বাস্তবায়ন করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
আগামী অর্থবছরে ৬টি চ্যালেঞ্জ দেখছেন অর্থমন্ত্রী। এরমধ্যে অপরিশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি মোকাবিলা। বাকিগুলো হচ্ছে-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, লেনদেনর ভারসাম্য পরিস্থিতি উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণের জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
আইএমএফ’র পরামর্শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে মূল্য সমন্বয় করতে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয় পদ্ধতি চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার চালিকা শক্তি হচ্ছে তরুণ-তরুণী। এদের প্রস্তুত করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্ত বিষয়ক প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে নতুন ৮০ হাজার তরুণ-তরুণীকে। আগামী অর্থবছরে শিক্ষা মনোন্নয়নে ৯০টি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাপক ও শিক্ষকসহ চারজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আর শিক্ষা ও শিক্ষক বিষয়ক ১৫টি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক খাতে আগামী অর্থবছরে ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিশুশ্রম কমিয়ে আনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে ২৮০০ শিশু শ্রমিককে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বের করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটি মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। এরমধ্যে বয়স্ক ভাতার পরিমাণ একশ টাকা, উপকারভোগী এক লাখ, বিধবা ভাতা ৫০ টাকা ও উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লাখ, প্রতিবন্ধী উপকারভোগীর সংখ্যা চার লাখ ৫০ হাজার বাড়ানো হয়। নারী ও শিশুদের নিয়ে ভাবছেন অর্থমন্ত্রী। ২০২৬ সালের মধ্যে স্কুলছাত্রীদের বাইসাইকেল প্রদান করবেন। ডে-কেয়ার সেন্টার, কর্মজীবী হোস্টেল ও জিম স্থাপন করবেন ৬৪ জেলায়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে কাজ শুরু করেছি। একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, উদ্ভাবনী, বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞাননির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত তৈরি করে দিয়েছে। এর ওপর দাঁড়িয়ে ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে বর্তমান উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সিরা এ সুবিধার আওতায় আসবেন। ৬০ বছরে পেনশনের অর্থ ফেরত পাবেন। সুবিধাভোগী পেনশন খাতের মোট জমার ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে নিতে পারবেন।
আপনি যা যা মিস করেছেন
Add A Comment