১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপে মোহামেডান ফাইনালে উঠেছিল। আর তাতে মোহামেডানকে যেভাবে কাপ উপহার দিলেন দিয়াবাতে এবং তাঁর সতীর্থরা, তা অনেক দিন মনে রাখার মতো। ফাইনালে আজ সেরাটাই দিয়েছে আবাহনীর বিপক্ষে। দুই গোলে পিছিয়ে দারুণ প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে ২-২ করেছে। ৩-২ গোলে পিছিয়ে পড়ে আবার করেছে ৩-৩। ফেডারেশন কাপের ইতিহাসে ফাইনালে এই প্রথম হ্যাটট্রিক করে ইতিহাস গড়লেন মোহামেডান স্ট্রাইকার ও অধিনায়ক সোলেমান দিয়াবাতে। মোহামেডানকে ‘জীবন’ দিয়ে বারবার ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছেন তিনিই।
এখানেই শেষ নয়। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধে নিজেই পেনাল্টি আদায় করে তা থেকে গোলও করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ৪ গোলে ম্যাচটা হয়ে দাঁড়ায় ‘দিয়াবাতের ম্যাচ’। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে বক্সের বাইরে থেকে আচমকা শটে ৪-৪ করেন আবাহনীর ডিফেন্ডার রহমত মিয়া।
এরপর টাইব্রেকারে প্রথম গোল দিয়াবাতের। কিন্তু আবাহনীর রাফায়েলের নেওয়া প্রথম শটটা আটকে দেন মোহামেডানের বদলি গোলকিপার আহসান হাবিব। মোহামেডানের চতুর্থ শট আটকে দেন আবাহনী গোলকিপার শহিদুল। আবাহনীর পঞ্চম শট নেন কলিনদ্রেস। কিন্তু শটটা আটকে দিয়েছেন মোহামেডান গোলকিপার। শেষ পর্যন্ত মোহামেডানের পঞ্চম শটে কামরুল গোল করতেই উল্লাসে ফেটে পড়েন সাদা-কালোরা। টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতে ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ ঘরে তুলেছে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানে।
আরও পড়ুন
এল ক্লাসিকো বা ম্যানচেস্টার-লিভারপুলের চাইতেও যে ম্যাচের উত্তাপ ছিল বেশি
এল ক্লাসিকো বা ম্যানচেস্টার-লিভারপুলের চাইতেও যে ম্যাচের উত্তাপ ছিল বেশি
হতাশ আবাহনী সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রথম ট্রফিশূন্য বছর কাটাল। আজ এগিয়ে গিয়েও জিততে পারল না দিয়াবাতেকে আটকাতে না পারার মাশুল গুনে। শক্তিতে এগিয়ে থাকা আবাহনী ১৬ মিনিটে এগিয়ে গিয়েছিল। এমেকার ডিফেন্স চেরা পাস। বাঁ পায়ের প্লেসিং ফাহিমের। মোহামেডানের গোলকিপার হাতে বল লাগালেও আটকাতে পারেননি।
৪৪ মিনিট হয়েছে ২-০। কোস্টারিকার জার্সিতে ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলা দানিয়েল কলিনদ্রেস কোনো ভুল করেননি। কোনাকুনি শটে বল পাঠান জালে।
মোহামেডানের হয়ে একাই ৪ গোল করেন সোলেমান দিয়াবাতে
মোহামেডানের হয়ে একাই ৪ গোল করেন সোলেমান দিয়াবাতেছবি: শামসুল হক
প্রথমার্ধেই দুই গোলে পিছিয়ে থাকা মোহামেডান কোচ আলফাজ আহমেদ পরিকল্পনায় বদল আনেন দ্বিতীয়ার্ধে। প্রতি–আক্রমণের কৌশল কাজে না লাগায় এবং উল্টো ২ গোল খেয়ে যাওয়ায় আক্রমণের ছকেই যান আলফাজ। আলমগীর কবির, জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার ইমনকে মাঠে পাঠান। মোহামেডানের আক্রমণেও আসে গতি। তারই ফল ৫৬ মিনিটে মোহামেডানের গোল। কামরুলের লম্বা বল। ক্লিয়ার করতে গিয়ে আবাহনীর ডিফেন্ডার আলমগীরের হেড ঠিকঠাক হয়নি। অরক্ষিত দিয়াবাতে বল বাতাসে রেখেই দারুণ প্লেসিংয়ে করেন ২-১।
আরও পড়ুন
১৪ বছর পর আবাহনী-মোহামেডান স্বপ্নের ফাইনাল
শেখ রাসেলকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে উঠেছে আবাহনী
চার মিনিট পরই স্টেডিয়ামে রীতিমতো উন্মাতাল অবস্থা মোহামেডান সমর্থকদের। স্কোরলাইন দাঁড়ায় ২-২। আবারও গোল সোলেমান দিয়াবাতের। দুই গোলে পিছিয়ে থাকা মোহামেডানের অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন দেখল ম্যাচটা।
কিন্তু নাটকীয়তার তখনো বাকি। খেই হারানো আবাহনী তৃতীয় গোলটা করে ম্যাচ আবার নিয়ে গেছে নিজেদের দখলে। ফয়সাল আহমেদের শট লাগে মোহামেডান গোলকিপার সুজন হোসেনের হাতে। ফিরতি বল সহজেই জালে ঠেলেন নাইজেরিয়ার স্ট্রাইকার এমেকা। এই গোলে আবার নেচে ওঠে আবাহনী গ্যালারি। এগিয়ে যায় তারা ৩-২ গোলে। কিন্তু ৭৯ মিনিটে আবার গোল মোহামেডানের। এবার দিয়াবাতের হ্যাটট্রিক।
আবাহনী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করলেও টাইব্রেকারে ভাগ্য সহায় হয়নি। গোলের এই হাসি শেষ পর্যন্ত থাকেনি
আবাহনী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করলেও টাইব্রেকারে ভাগ্য সহায় হয়নি। গোলের এই হাসি শেষ পর্যন্ত থাকেনিছবি: শামসুল হক
১৯৮৬ সালে আবাহনী-মোহামেডান ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে ৪-৪ গোলে শেষ হয়েছিল। হ্যাটট্রিক করেছিলেন আবাহনীর শ্রীলঙ্কান স্ট্রাইকার প্রেমলাল। সেই প্রেমলালকে আজ মনে করিয়ে দিলেন দিয়াবাতে। সাদামাটা একটা দল নিয়ে তিনি দুর্দান্ত লড়াই করলেন। একাই ম্যাচটা নিয়ে যান অতিরিক্ত সময়ে এবং তাঁর নৈপুণ্যে জয়োল্লাসেও মেতে ওঠেন সাদা-কালোরা।
আরও পড়ুন
আবাহনী–মোহামেডান রোমাঞ্চ কেন হারিয়ে গেল
আবাহনী–মোহামেডানের ঐতিহ্য, এ দুটি ক্লাব নিয়ে মানুষের আবেগও নষ্ট করেছি আমরা।
এই ম্যাচ নিয়ে কুমিল্লায় দর্শক–আগ্রহ তৈরি হয়েছিল অনেক। স্থানীয় এক দৈনিকের আজকের প্রথম পাতায় ছবিসহ প্রধান শিরোনামে এসেছে ম্যাচটা। ম্যাচ দেখতে কুমিল্লা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে বিভিন্ন সংস্থায় সৌজন্য টিকিট পাঠানো হয়। তবে বেশির ভাগ ঢাকা থেকে আসা সমর্থক। আবাহনীর কয়েক গাড়ি সমর্থক এসেছে। মোহামেডানের তার চেয়ে বেশি।
তবে দুই দলের সমর্থকেরা আসার পর কুমিল্লা ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামের গ্যালারি পুরো ভরেনি। পশ্চিম দিকে গ্যালারির অনেকটা ভরে গেলে পূর্ব দিকে মোহামেডান গ্যালারির কিছুটা খালি ছিল। সেটার কারণ হতে পারে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে বেলা তিনটায় খেলা। তারপরও ১৮-১৯ হাজার দর্শক ধারণের গ্যালারি ৭০ ভাগের বেশি ভরে গেছে।
ফাইনাল দেখতে ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শকের সমাগম হয়েছিল
ফাইনাল দেখতে ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শকের সমাগম হয়েছিলছবি: শামসুল হক
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে এসেছেন বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। এসেছেন আরও অনেকেই। শেষ পর্যন্ত মোহামেডান জিতেছে। ২০১৪ সালে ফেনী সকারকে হারিয়ে স্বাধীনতা কাপ জয়ের ৯ বছর পর মোহামেডানের ঘরে একটি ট্রফি গেল। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে সাদা-কালো সমর্থকদের কাছে। আজকের বিকেলটা তাই শুধুই তাঁদের!