সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জ ১ আসনের সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্বে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ ভবনের প্রায় সাত কোটি টাকার দরপত্র বাতিল হয়ে গেছে। ফলে এই ভবন নির্মাণ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এই বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়, প্রধানমন্ত্রীর নিকট উন্নয়ন বিরোধী এই কাজের জন্য লিখিত অভিযোগ দেবার কথাও জানিয়েছেন। অপরদিকে, স্থানীয় সংসদ সদস্য বলেছেন বর্তমান স্থানে ৫৫ টি গাছ কর্তন করতে হয়। এজন্য এর স্থান পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
ভবনটির দরপত্রের কাগজপত্রে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে ২০২১ সালের দুই মার্চ তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ ভবন নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ভোলার চরফ্যাশনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সাইমুম ট্রেডার্সকে তাহিরপুর উপজেলা প্রকৌশলী ইকবাল কবীরের স্বাক্ষরে দেওয়া কার্যাদেশ’এ গত বছরের ছয় জুন কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ওই বছরের দুই অক্টোবর উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ কাজের উদ্ধোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন।
এসময় সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক অপু উকিল, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খান ও সাধারণ সম্পাদক অমল করসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে গেল বছরের পহেলা জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ সামছুল হক নির্মাণ স্থানে থাকা ৫৫ টি গাছ কাটারও অনুমোদনের চিঠিও পাঠান সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে। অপর আরেক চিঠিতে মোহাম্মদ সামছুল হক উপজেলা পরিষদের পুরাতন দুটি টিনশেড ভবন ও একটি টিনশেড অডিটোরিয়াম ভাঙারও অনুমতি দেন।
এরপর ভবনের নীচের কিছু ফাউন্ডেশনের কাজও হয়। এরমধ্যেই গেল বছরের ৩১ জানুয়ারি উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনটি স্থান পূন: নির্ধারণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার (অনুরোধপত্র) দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন।
ডিও লেটারে তিনি উল্লেখ করেন, তাহিরপুর উপজেলায় ৫৫ টি গাছ কর্তন করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে তাহিরপুর উপজেলা কমপ্লেক্স’এর স্থানটি নির্ধারণ করা হয়। চিঠিতে তিনি উপজেলা পরিষদ ভবনের পাশের হাওরে তিন দশমিক ৪৪ একর ভূমিতে ভবন নির্মাণ কাজ স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ওই ভূমির জন্য সরকারের কোন আর্থিক সহায়তা দেওয়া লাগবে না। সরকারের অনুমতি পেলে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের নামে এই ভূমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে। এই ডিও লেটারের পর ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ সামছুল হক গত ৩০ মে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসককে পাঠানো চিঠিতে সংসদ সদস্যের চিঠির কথা উল্লেখ করে তদন্ত করে এই বিষয়ে রিপোর্ট দেবার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর আর এই বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয় নি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুছ ছোবহান আখঞ্জি বললেন, ‘‘পাঠা-পুতাইলে ঘষাঘসি মরিচর কাম শেষ’ আমরা পড়েছি সেটিতে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ভবনের তহবিল এনেছেন, এমপি সাহেব আটকে দিয়েছেন। আমরা চাই ভবনটি হোক। এখন যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেটি মূলত ভবন নির্মাণ আটকানোর জন্য।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক শফিকুল ইসলাম বললেন, ভবনের দরপত্র বাতিল হওয়ায় আমরা কষ্ট পেয়েছি। তাতে তাহিরপুরবাসীর ক্ষতি হলো। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তাঁর নিজের উদ্যোগে নানা জায়গায় ধরণা দিয়ে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের তহবিলের ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার মনে হয়েছে এমপি সাহেবকে ফাস কাটিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ভবনের তহবিলের ব্যবস্থা করায়, বিরাগ ভাজন হয়েছেন এমপি সাহেব। তিনি সেটি আটকে দিয়েছেন। মূলত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে (সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকায় মনোনয়ন চাইবেন) মনোনয়ন চাইবেন আওয়াজ দেওয়ায় দু’জনের দুরত্ব বেড়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খাঁন বললেন, উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের এলাকা যাতে আর বড় করা যায়, এজন্য পাশের হাওরের দিকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় জমি কিনে দিয়েছেন এমপি সাহেব। ওখানেই হবে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন। ভবনটি আটকানোর কোন উদ্দেশ্য নয় কারোরই।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বললেন, এই বিষয়ে ভালো বলতে পারতেন তাহিরপুর উপজেলা প্রকৌশলী। তিনি সম্প্রতি বদলি হওয়ায় নতুন প্রকৌশলী বিস্তারিত জানেন না। এই কন্ট্রাকটি গেল বছরেই বাতিল হয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন সরিয়ে নেবার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেওয়ায় কাজটি তখন বন্ধ করা হয়েছিল।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বুধবার বিকালে এই প্রতিবেদককে জানান, এই বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমাও একই ধরণের মন্তব্য করে বললেন, উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবকে ফোন দিলে এই বিষয়ে জানতে পারবেন।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বললেন, সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স’এর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছিল। সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতেই চলমান নির্মাণ কাজ বন্ধ করা হয়েছে। সংসদ সদস্য কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজের উদ্বোধনও করলেন, আবার ভবনের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য ডিও লেটার দেওয়ায় আমি হতভম্ব হয়েছি।
তিনি বলেন, বিষয়টি রহস্যজনক। নির্মাণ কাজ বন্ধ করে তাহিরপুরবাসীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন বিরোধী কর্মকাণ্ড বলে মনে করি আমি। এই বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষপ কামনা করবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে হাওরের ক্ষতি না করে অবকাঠামো করার জন্য, অথচ তিনি (এমপি সাহেব) হাওরে স্থাপনা করার জন্য বলছেন। ওখানেও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় আছে।
তিনি আরো জানালেন, কাজ আটকানোর জন্য পরিবেশ কর্মীদের বার বার ফোন দেওয়া হয়েছে, ওরা যাতে তাহিরপুর সদরে মানববন্ধন করে এমন অনুরোধও করা হয়েছে, এটিও আমি জানি। পরিবেশ কর্মীরা আমাকে এসব খবর জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ ১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বললেন, ৫৫ টি গাছ কর্তন করে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স হতে পারে না। উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স’এর জন্য জমি কিনে দিয়েছি আমি। সেটি দলিল হয়ে গেছে। এর বেশি এই বিষয়ে বলতে চান নি তিনি।