মেহেদী হাসান অর্নাস ২য় বর্ষের ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই সে শিক্ষানুরাগী, মেধাবী, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে টিফিনের টাকা জমিয়ে নিজ গ্রামে তৈরি করেছেন ‘বই ঘর পাঠাগার’।
শহরে বই পড়ার সুযোগ কমবেশি থাকলেও গ্রামের চিত্র একেবারে ভিন্ন। গ্রামের মানুষগুলোর বই পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পাঠাগার না থাকায় সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল জ্ঞানপিপাসু মানুষের নিজ গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল মেহেদীর।

২০২০ সালে পাঠাগার স্থাপন করেন বইপ্রেমী গাইবান্ধা সদর উপজেলার টেংগরজানি গ্রামে মো: হান্নান মিয়ার পুত্র মেহেদী হাসান (২০)। সে গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অনার্স ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। গ্রামে নিজের বাড়ির সামনেই গড়ে তোলেন ‘বই ঘর পাঠাগার’। বর্তমানে পাঠাগারটি আলো ছড়াচ্ছে গাইবান্ধা জেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নসহ পাশ্ববর্তী উপজেলার মানুষের মাঝে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা শহরে থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দুরে গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ্বেই টেংগরজানি গ্রাম। সেখানে ৩৮ ফুট দের্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থা একটি আধাপাকা টিনের ঘরে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বই ঘর পাঠাগার’। শিশু-কিশোরদের বই থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য, বিনোদন, রাজনীতি, অর্থনীতি, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রচনাসমগ্র, জীবনী, ছোটগল্প, কবিতা, ভাষাতত্তসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখার বই রয়েছে এই পাঠাগারে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও দুষ্প্রাপ্য প্রকাশনার খোঁজ মেলে এখানে।

বর্তমানে তার পাঠাগারে বই রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিকের অধিক। প্রতিদিন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন পাঠক বই ও পত্রিকা পড়তে আসেন এ পাঠাগারে। পাঠাগারের সদস্যদের জন্য বই বাড়িতে নিয়েও পড়ার সুবিধা রয়েছে। মেহেদীর পাঠাগারে অধিকাংশ পাঠক বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বই ও পত্রিকা পড়তে আসেন। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করতে অভিযানও চালিয়ে যাচ্ছেন মেহেদী।

টেংগরজানী গ্রামের শিক্ষার্থী আফরোজা আক্তার বলেন, ‘আমাদের গ্রামে এমন একটি পাঠাগার গড়ে উঠবে ভাবতে পারিনি। আমরা পড়াশুনার পাশাপাশি প্রতিদিন পাঠাগাড়ে গিয়ে পছন্দের বই পড়ছি। এখানে বই পড়তে খুব ভালো লাগে। আরেক শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে চার-পাঁচ মিনিট হেঁটেই ওই পাঠাগারে আসা যায়। তাই সময় পেলেই পাঠাগারে এসে বই পড়ছি এবং সেখান থেকে বই বাড়িতে নিয়েও আসি। বই পড়া শেষ হলে ফেরত দিয়ে আবার নতুন বই নিয়ে আসি।’

নিশাদ বাবু বলেন, ‘বই ঘর পাঠাগারের উদ্যোক্তা মেহেদী নিজের অর্থায়নে বই পড়ার অভিযানকে বেগবান করেছেন। এটা সত্যিই বিরল। সে লেখাপড়ার পাশাপাশি গ্রামে পাঠকের চাহিদা পুরণ করেছেন। এতে যে শুধু গ্রামের মানুষ উপকৃত হচ্ছে তা নয়, আশেপাশের অনেক মানুষ বই ঘর পাঠাগার থেকে জ্ঞান অর্জন করছেন।’

গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, শুধু বইপড়া নয়, পাশাপাশি নানা ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে বই ঘর। পাঠাগার থেকে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন, জাতীয় দিবস পালন, চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান, গল্পলেখা, কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করা হয়।

পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ মেহেদী হাসান বলেন, আমরা যারা গ্রামে বসবাস করি, তাদের শহরে গিয়ে বই পড়া বড় সমস্যা। কারণ, দেশের বেশির ভাগ পাঠাগার শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা কারণ বর্তমানে সকলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, গেমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। তাই আমি আমার পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি পরিচিত জনের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করা শুরু করি। কলেজ যাওয়ার ভাড়া ও টিফিনের অতিরিক্ত টাকা জমা করে ও বাবা-মার সহযোগিতায় ২০২০ সালে শুরু করি পাঠাগার।

মেহেদী আরো জানান, অর্থাভাবে পাঠাগারের বই বৃদ্ধি করতে পারছি না। সরকারি অনুদান ও সহযোগিতা পেলে পাঠাগারে বই বৃদ্ধি করা সহজ হবে। তাই এই পাঠাগারটিকে একটি আধুনিক পাঠাগার হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক সোহাগ মৃধা বলেন, ‘বই ঘর পাঠাগারে আমি নিজেও গিয়েছি। নিজের অর্থায়নে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে গ্রামের মানুষদের বই পড়ার আগ্রহকে বেগবান করার পাঠকের চাহিদা পূরণ করে আসছেন। তার এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই।

স্থানীয় লোকজনের কাছে মেহেদীর পাঠাগার সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, পাঠাগারটি তৈরি হওয়ায় গ্রামের দৃশ্যপট অনেকটা বদলে গেছে। যে সময় গ্রামের ছেলে মেয়েরা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা এখন নিয়মিত পাঠাগারের এসে বই পড়ে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ নুরুল ইসলামের নিকট মেহেদীর পাঠাগার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামে মেহেদী যে পাঠাগারটি তৈরি করেছে এটা সত্যি বর্তমান সময়ে প্রসংশা পাবার যোগ্য। কেননা, তার মতো অল্প বয়সে ছেলেরা যেখানে টিফিনের টাকা দিয়ে ধুমপান ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে মেহেদী তরুণ হয়ে অন্য তরুণ প্রজন্মের জন্য শিার আলো ছড়িয়ে দিতে পাঠাগার তৈরি করেছে। এজন্য তাকে সাধুবাদ জানানো দরকার।

গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা জেলা সরকারি গণ-গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মোঃ সাইফুল ইসলাম গণ গ্রন্থাগার অধিদফতরের তালিকাভুক্তিকরণ সনদ প্রদান করেন বই ঘর পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মোঃ মেহেদী হাসান নের নিকট। এসময় সদস্য মোল্লা আরিফা রহমান নদী উপস্থিত ছিলেন।
গাইবান্ধা জেলা সরকারি গণ-গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, পাঠাগারের অবকাঠামো, রেজিস্ট্রারসহ যাবতীয় ডকুমেন্টস সঠিক থাকায় এ নিবন্ধন প্রদান করা হয়। তিনি আরও বলেন, বই ঘর পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মোঃ মেহেদী হাসান স্বপ্ন দেখেন একটি আলোকিত সমাজের যেখানে থাকবে না কোনো নিরর মানুষ, থাকবে না কোনো অন্ধকার। ছোট্ট মানুষের আকাশসম স্বপ্ন। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নানা দিকনির্দেশনাসহ তার পাশে থাকবে গণ-গ্রন্থাগার।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version