তানভীর আহমেদ: সুনামগঞ্জ:
হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউড়ের গড়ে এবার তুলনামূলক বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় দেশের জাতীয় ফল কাঁঠালের উৎপাদন ভালো হয়েছে। এ গ্রামে উৎপাদিত ফলটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি ফলে কোনো প্রকার ক্যামিক্যাল মিশ্রণ না করায় নিরাপদ। ফলে এই অঞ্চলের কাঁঠালের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। অনেকের কাছে ঐতিহ্যবাহি এই লাউড়ের গড় গ্রামটি এখন কাঁঠালের গ্রাম হিসেবেই পরিচিত।

সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার মধ্যে শুধু তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের লাউড়েগড় গ্রামে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল ধরে। এমনকি রাস্তায় কাঁচা, পাকা কাঁঠাল পড়ে থাকলেও তা নেয়ার মতো কেউ থাকে না।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দেশে অনেক রকমের ফলের গাছ থাকতে এই গ্রামের মানুষ বাড়ির সামনে থেকে শুরু করে পেছন পর্যন্ত শুধু কাঁঠাল গাছই লাগিয়েছেন। আর সেই গাছগুলোর নিচ থেকে শুরু করে ওপর পর্যন্ত শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল। এমনকি সরকারি, বেসরকারি রাস্তার পাশেও গ্রামের মানুষেরা কাঁঠাল গাছ রোপণ করেছেন। সূর্যের আলো যখন কাঁঠাল গাছগুলোর ওপর পড়ে তখন এক দৃশ্য ঝিলমিল করে।

লাউড়ের গড় গ্রামের বাসিন্দা গণমাধ্যম কর্মী আলম সাব্বির বললেন, পাহাড়ের কাছাকাছি অপেক্ষাকৃত উঁচু গ্রাম লাউড়ের গড়ের মাটিতে বেলে ও দোয়াস মাটির সমন্বয় আছে। এই জন্য এই মাটিতে কাঁঠাল গাছ হয়। এই গ্রামে দুই ধরণের কাঁঠাল গাছ হয়। এক প্রকারের কাঁঠালকে বলা হয় খাঁজা কাঁঠাল, আরেকটা হাজারী কাঁঠাল। খাঁজা কাঁঠালের খোয়া বড় হয়, এই কাঁঠালকে করচা কাঁঠাল বলা হয়, এই কাঁঠালের ভেতর কোয়া কম থাকে। হাজারী কাঁঠালের কোয়া অপেক্ষাকৃত ছোট ও নরম হয়, ভেতরে কোয়া থাকে বেশি। লাউড়ের গড়ের কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল আসা শুরু হয় ফাল্গুন মাসে, জৈষ্ঠ্য থেকে আষাড় মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত গাছে কাঁঠাল ফাকে।

আলম সাব্বির জানালেন, শাহ্ আরেফিন (র.) টিলার পাশের এই গ্রামে রেওয়াজ আছে কাঁঠাল মৌসুমে সকল আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিজের গাছের বাছাই করা কাঁঠাল পাঠানো। এরপর বিক্রি।

লাউড়েগড় গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কাদির বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মা-বাবার কাছ থেকে শুনেছি আমাদের গ্রামে রাজ-রানি সবাই ছিল এবং আমাদের গ্রামকে “লাউড়ের রাজ্য’ বলা হতো, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সব বদলে গেছে। এখন এই গ্রামে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল পাওয়া যায় বলে এই গ্রামকে সবাই “কাঁঠালের রাজ্য” হিসেবে চেনে।’

ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়ির সামনে-পেছনে ২০টি কাঁঠাল গাছ আছে, যার সব কয়টিতে কাঁঠাল ধরেছে। প্রতিবছর গাছগুলোর কাঁঠাল আমরা নিজেরা খাই, বিক্রি করি এবং দূর-দূরান্তের সব আত্মীয়-স্বজনের বাসায় পাঠিয়ে দেই।’

একসময় কিছুই ছিল না গ্রামের বাসিন্দা রহমত আলীর। দিনমজুরির কাজ করতেন। পরে অনেক কষ্ট করে দুই শতক জায়গা কিনে সেই জায়গায় শুধু কাঁঠাল গাছের চারা রোপণ করেন।

তিনি বলেন, ‘গাছ বড় হয়ে যখন কাঁঠাল ধরা শুরু করল তখন সেই কাঁঠাল বিক্রি করে আমার সুখের দিন ফিরল। এরপর থেকে আমার বাড়ির চারপাশসহ সব জায়গায় আমি নিজে কাঁঠাল গাছ লাগাই এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করি।’

সুনামগঞ্জের বাসিন্দা মাছুম আহমেদ বলেন, ‘ তীব্র এই গরমের মধ্যে লাউড়েগড় আসছি কাঁঠাল কিনে নিয়ে বাসার সবাই একসাথে খাব বলে। আমি প্রতি বছর কাঁঠালের সময় আসলে এই গ্রাম থেকে কাঁঠাল নিয়ে যাই। কারণ এই গ্রামের কাঁঠাল অনেক সুস্বাদু।’

বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, লাউড়েগড় গ্রামে বালু ও মাটি ভালো থাকায় এই গ্রামে কাঁঠালের খুব ভালো ফলন হয়। তবে কৃষি বিভাগ থেকে যদি এই গ্রামের মানুষকে আরও উৎসাহ দেয়া হতো তাহলে গ্রামের মানুষের উপকার হতো।

তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান-উদ-দৌলা বলেন, ‘তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েগড় গ্রামে কাঁঠাল বেশি হয়। তাই সবাই গ্রামটিকে ‘কাঁঠালের গ্রাম’ বলেই চেনেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের সব রকমের সুবিধা দেয়া হয়। ভবিষ্যতেও এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত লাউড় রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রামের নাম ‘লাউড়ের গড়’, যা এক সময় ‘লাউড়ের রাজধানী’ হিসেবে বিখ্যাত ছিল। তখনকার সময়ে কী ছিল না সেখানে! রাজা, রানি, প্রজাসহ যেন আলাদা একটা রাজ্যই ছিল সেখানে। এই উপজেলার উত্তরে- ভরতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা এবং পশ্চিমে ধর্মপাশা উপজেলা অবস্থিত।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, দ্বাদশ শতকে কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র বংশের কেশব মিশ্র প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন লাউড় রাজ্য ছিল সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ জেলার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু বর্তমানে সেই রাজ্য এখন কিছুই নেই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলে গেছে। বদলে গেছে সেই বিখ্যাত লাউড়ের রাজধানীর নামও। এখন সেই লাউড়ের রাজ্যকে একনামে সবাই ‘কাঁঠাল রাজ্য’ হিসেবে চেনে। আবার অনেকের কাছে ঐতিহ্যবাহি এই লাউড়ের গড় গ্রামটি এখন কাঁঠালের গ্রাম হিসেবেই পরিচিত।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version