মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলের কৃষকদের একমাত্র সম্বল বোরো ফসল। হাওর পারের কৃষক এ বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল। তাদের পুরো বছরের খোরাকী এবং সকল ব্যয়ভাড় বহন করে চলে ধান বিক্রি’র টাকা দিয়ে। কৃষকরা ধার দেনাও মিটান ওই টাকা থেকে।
তবে, এবছর বোরো মৌসুমে দীর্ঘমেয়াদী খরা, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ও পানি সেচের সুবিধা না থাকায় জেলার হাওরগুলোতে কৃষকের রোপণকৃত ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ধানে চিটা ধরায় চরম লোকসানে পড়েছেন হাওর পারের কয়েক হাজার প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষীরা।
কোথায়ও পুরো জমির ধানে চিটা ধরায় শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে ধান কেটে লাভবান হবেন না দেখে অনেক কৃষক ধান কাটতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
তবে জেলার সচেতন মহল বলছেন, মৌসুমের শুরু থেকে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা তৎপর হলে এমনটি হতো না।
মৌলভীবাজারে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, হাইল হাওর, করাইয়ার হাওর ও বড় হাওরসহ ছোট বড় বেশ কয়েকটি হাওর রয়েছে। এসব হাওরের প্রধান ফসল বোরো ধান। কিন্তু ওই সকল হাওরে ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ধানে চিটা ধরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। একদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্য দিকে বোরো চাষাবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন কৃষকরা।
জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, জেলায় এ বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার ৭’শ ৫০ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ৫৭ হেক্টর। হাওরে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৫১ হেক্টর জমি।
তবে স্থানীয়রা বলছেন হাওরগুলোতে আবাদকৃত পুরো ব্রি-২৮ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যার পরিমাণ সরকারি তথ্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। গত বছর হাওরের যে এলাকায় (মৌজায়) প্রতি বিঘাতে ১৫ থেকে ২০ (মণ ধান) পেয়েছেন কৃষকরা। এ বছর ওই এলাকায় প্রতি বিঘাতে কৃষকরা ৪ থেকে ৫ মণ ধান পাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য সাহেদ আহমদ জানান, ৮০ শতাংশ ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধান জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ধান কাটতে চাইছেন না কৃষকরা। আমিও গত সোমবার কিছু ধান কেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
কৃষক রিয়াজুর রহমান জানান, অতিরিক্ত ওষুধ এবং স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে এমনটি হয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এতো বড় বিপর্যয়ের মুখে পরতে হতো না কৃষকদের।
বাদে ভুকশিমইল গ্রামের আরিফুর রহমান জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন কৃষি উপ-সহকারী আছেন এটা আমি সহ অনেক কৃষকই জানেন না। কৃষকের সংকট কিংবা দুর্দিনে তাদের কোন ভাবে কাছে পায়নি।
হাওর কাউয়াদীঘির পূর্ব পারের পশ্চিম ভাগ গ্রামের খায়রুল মিয়া ও মতিন মিয়া জানান, ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্তের কারণে চিটা ধরায় আমরা অনেক লোকসানে পড়েছি। গত বছর প্রতি বিঘাতে যে জমিতে ১৫ মণ ধান পেয়েছিলাম। এবার ৩ মণ ধান পেতে পারি।
একই এলাকার শহিদ মিয়া, সাদিকসহ অনেকে জানান, এ বছর খরার কারণে এবং পানির অভাবে আমাদের জমির ধানে চিটা ধরে অনেক জমির ধান কাটার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আবার যে সকল জমিতে ধান হয়েছে তার উৎপাদন ও অনেক কম।
এ হাওরের ছালিক মিয়া জানান, সময় মতো বৃষ্টি না হওয়াতে এবং নদী, খালে পানি না থাকায় জমিতে পানি দিতে পারিনি। তাই আমার কয়েক বিঘা ধানি জমি নষ্ট হয়েছে।
মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ জানান, আবহাওয়ার কারণে ধানে ব্লাস্ট রোগ আক্রান্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। রাতে ঠান্ডা-দিনে গরম এই পরিস্থিতিতে ব্রি-২৮ জাতের ধানের জন্য খুবই ক্ষতিকর প্রভাব পরেছে। আমরা কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে আসছি ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপণ না করতে। কিন্তু তার পরেও কৃষকরা ব্রি- ২৮ জাতের ধান রোপণ থেকে সরে আসছেন না তারা।