অনলাইন ডেস্ক: সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে সবার সহায়তার ওপর তাগিদ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। একই সঙ্গে তিনি গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে চলমান বিশেষ অধিবেশনে শুক্রবার বিকেলে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এ আহ্বান জানান। একাদশ সংসদের ২২তম অধিবেশনটি গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় শুরু হয়। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম শুরু হয় বিকেল ৩টায়। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদের এটিই জাতীয় সংসদে শেষ ভাষণ বলে মনে করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আগামী ২৩ এপ্রিল তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে।
আবদুল হামিদ বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সবার সহায়তা করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।’
জাতির বীর, সাহসী সূর্যসন্তানেরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে গেছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব এই দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এই মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আমি আজ দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি- আসুন, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যেকোনো উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হতে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।’
জাতীয় সংসদকে গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের সব বিভাগের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে আদর্শ স্থাপনের গুরুদায়িত্ব বর্তায় এ মহান সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের ওপর। কেবল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতরাই সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং জনগণের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেন। এ বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী উভয়পক্ষের মাননীয় সংসদ সদস্যরাই জাতির নিকট দায়বদ্ধ। এই উপলব্ধি থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে আমি এ মহান সংসদে মাননীয় সংসদ সদস্যদের গঠনমূলক, কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’
এসময় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘জাতীয় সংসদের কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হলে সংসদ সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। যুক্তিতর্কের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতে হবে। সংসদ সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হলে সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি, সংসদীয় রীতিনীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে । এছাড়া সংসদের অতীত কার্যবাহ থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হতে হলে আপনাদের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসদ লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন আর সশরীরে লাইব্রেরিতে না গিয়ে অনলাইনে সবকিছু সংগ্রহ করা যায়।’
আবদুল হামিদ বলেন, ‘গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়। মনে চাইলো কোনো দেশ থেকে পরিমাণমত গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানি করলাম, বিষয়টি এমন নয়। চর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংসদের কার্যবাহে সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলো পড়লে বোঝা যায় সংসদকে কীভাবে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হয়।’
‘পরমতসহিষ্ণুতা, বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং অন্যকে কীভাবে সম্মান দেয়া যায় এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় নজির রেখে গেছেন’, বলেন রাষ্ট্রপ্রধান।
আবদুল হামিদ তার ভাষণে রাজনীতিতে পদার্পণ থেকে শুরু করে, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য-সান্নিধ্যলাভ, ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার পদে আসীন হওয়া এবং সবশেষ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্বগ্রহণের বিভিন্ন পথপরিক্রমা তুলে ধরেন।
রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ও যোগ্য নেতৃত্বে বিগত দেড় দশকে দেশের প্রতিটি সেক্টরে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও বিশ্বে যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে সরকারের আর্থসামাজিক ও বিনিয়োগধর্মী নানামুখী প্রকল্প, কর্মসূচি এবং কার্যক্রম গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার কমার পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে।’
‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী দেশে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির মূলধারায় ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আশ্রয়ণ, ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বিতরণ ও কর্মসংস্থান প্রভৃতি কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। কদিন আগেও প্রায় চল্লিশ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি তৈরি করে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২১১টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে এবং ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দেশের সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে এবং ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি আত্মমর্যাদাশীল, দেশপ্রেমিক জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে একটি অনন্য পরিচয়। সে পরিচয়কে আমাদের ঐকান্তিকতা, সততা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে সমুন্নত রাখতে হবে। দেশের উন্নয়নে আমাদের চিন্তা, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে সুগভীর ঐক্য থাকবে জাতীয় স্বার্থ ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে। হিংসা-বিভেদ নয়, স্বার্থের সংঘাত নয়-আমাদের সামনে রয়েছে আজ দেশ গড়ার কাজ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে দিয়ে যাব একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ- এই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।’
টিএমবি/এইচ