রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে ২ ভূয়া সাংবাদিকেরা কারিশমা

তাহিরপুরে ২ ভূয়া সাংবাদিকের কারিশমা:
ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেইল করে ২২ হাজার টাকা চাঁদা আদায়
স্টাফ রিপোর্টার :
‘হাওর কন্ঠ’ নামে একটি ফেসবুক পেজের সম্পাদকসহ বিভিন্ন সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের “সাংবাদিক” পরিচয়ে অপরাধ জগতে আবির্ভাব তাদের। সাংবাদিক পরিচয়ের পাশাপাশি কখনো ছাত্রলীগ, আওয়ামী নবীণ লীগ, কখনো সজিব ওয়াজেদ জয় পরিষদের তাহিরপুর উপজেলা শাখার সভাপতি সম্পাদক পরিচয় বহন করলেও আদতে এমন কমিটির অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ এক ব্যবসায়ীকে বø্যাকমেইল করে ২২ হাজার টাকা চাঁদা আদায়ের ঘটনায় তাদের ভূমিকা নিয়ে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। এদের একজনের নাম আবু জাহান মিয়া (২৫) আরেকজন এম.ডি মুরাদ (২৭)।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এলাকায় পুলিশ কিংবা বিজিবি গেলে কৌশল অবলম্বন করে কোন রকম একটি ছবি তুলে কেটে পড়ে এই দুই চাঁদাবাজ। পরে এ ছবি পোস্ট করে দাম্ভিকতার পরিচয় তুলে ধরে আমজনতার কাছে। গভীররাতে বাজার ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে হরহামেশা ঘুরঘুর করে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করে তারা। সাংবাদিক পরিচয়ধারী আবু জাহান মিয়া সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের তরং গ্রামের শাহ আলমের ছেলে। তার ঘনিষ্ট সহযোগী এম.ডি মুরাদ পাশ্ববর্তী শ্রীপুর উত্তর (কুড়েরপাড়া) গ্রামের বিএনপি নেতা সাবেক ইউপি সদস্য শাহানূর মিয়ার পুত্র।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাংবাদিক পরিচয়ের প্রথম ধাপে তরং গ্রামের এক আওয়ামী লীগ নেতার স্কুল পড়োয়া মেয়েকে ইভটিজিং করে আলোচনায় আসে আবু জাহান। দেয়া হয় তাহিরপুর থানায় ইভটিজিংয়ের অভিযোগ। অভিভাবকের পা ধরে ঘটনা গিলে ফেলে ওই বহুরুপি। অভিযোগ রয়েছে, জুয়া বোর্ডের একাধিক ব্যক্তির ভিডিও ধারণ করে তার কব্জায় নিয়ে শ্রীপুর বাজারে চলমান জুয়া বোর্ড থেকে বিভিন্ন নামে প্রতিদিন ৫শ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সে। চলতি বছর নৌ-পথে বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগে জাহান মিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে একটি চাদাঁবাজির মামলা করেন দুধের আউটা গ্রামের কয়লা ব্যবসায়ী মল্লিক মিয়া। পরবর্তীতে জেলা শহরের এক সাংবাদিক নেতার বদৌলতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেন খাঁনের পায়েপড়ে মামলা থেকে নিজেকে আত্মারক্ষা করে সে। অন্যদিকে নাম সর্বস্ব বিভিন্ন অনলাইনে মিথ্যা সংবাদ প্রেরনের মাধ্যমে জালিয়াতি প্রতারনা ও ব্ল্যাকমেইলের ঘটনায় অভিযোগ এনে ব্যবসায়ী আবুল বাশার খাঁন নয়ন তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে আবুজাহান গংদেরকে অভিযুক্ত করে তাহিরপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সে সময়ে।

এর আগে পার্শ্ববর্তী তেলীগাও গ্রামে সংখ্যালঘু কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে লোমহর্ষক এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয় জাহান মিয়া। পরে সাংবাদিকদের সহায়তায় পুলিশের দারস্থ হলে ন্যায় বিচার কার্যক্রম চলে।

সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ-বিজিবি, সাংবাদিক ম্যানেজ করার অঘোষিত দায়িত্ব নিয়েছে চাঁদাবাজী মামলার তকমা লাগা কথিত সাংবাদিক আবু জাহান। সীমান্ত-হাওর জনপদের মাঝামাঝি বাড়ি হওয়ায় এলাকায় যত অপরাধ কর্মকান্ড ঘটে তা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব নেয় এই সাংবাদিক পরিচয়ধারী। সর্বশেষ নিরীহ এক কয়লা ব্যবসায়ীকে ফিল্মি স্টাইলে ব্ল্যাকমেইল করে পুলিশ-বিজিবি, সাংবাদিকদের নাম ভাঙিয়ে হাতিয়ে নেয় ২২ হাজার টাকা। গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) দুপুরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের সমসার বাধঁ এলাকায় এ তুঘলকি কান্ড ঘটে। এমন খবর দ্রæত পৌঁছে যায় সর্বত্র। এদিকে ওই ব্যবসায়ীকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে বিভিন্ন নামে চাঁদা আদায়কারি জাহান মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ।

মূলধারার সাংবাদিকদের করা প্রতিবেদন শেয়ার দিয়ে ”নিউজটি কেমন হলো’ এমন বাক্য ব্যবহার করে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে নিজের দৌরাত্ম্য বহিঃপ্রকাশ, মূলধারার সাংবাদিকদের বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করেও ফন্দি-ফিকির বাড়িয়ে নেয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত সে। নদীপথে স্পীটবোর্ড আর সড়কপথে প্রাইভেট কারে চলে নিজেকে “বিরাট কিছু” বানাতে মরিয়া প্রতারক জাহান ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহান মিয়ার বাবা দীর্ঘ ৫ বছর ধরে রোগশয্যায়। বাবার জন্য দোয়া না চাইলেও জেলার প্রভাবশালী লোকদের প্রতিনিয়ত উলুধ্বনী করে দয়াদাক্ষিণ্য প্রত্যাশার কুটচালে স্বচেষ্ট সে। শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এ জনপদের মানুষজন চুন থেকে পান কষলেই চটকদারি বাক্য লিখে ‘বিস্তারিত আসছে’ এমন স্ট্যাটাস লেপ্টে দিয়ে জনমনে ভীতি সঞ্চার করে ফায়দা হাসিল করে। অন্তত ডজনখানেক সিম ব্যবহারের পাশাপাশি তার রয়েছে ডজন উর্ধে ফেক ফেইসবুক আইডি।

নৌ-পথে গভীর রাতে চাঁদাবাজির সময় মন্দিয়াতা গ্রাম সংলগ্ন পাটলাই নদীতে সংঘর্ষ বাধে সাংবাদিক পরিচয়ধারী অপর গ্রæপের সাথে। পরদিন শ্রীপুর বাজারে বিচার শালিসের মাধ্যমে বিষয়টি নিস্পত্তি করেন এলাকাবাসী। সমবয়সী নয়াবন্দ গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে গায়েপড়ে কথা কাটাকাটি করে টেকেরঘাটে থাকা পুলিশ দিয়ে ওই যুবককে আটক করে, পরে বড়ছড়া এলাকার রাজু নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার হস্তক্ষেপে ছাড়া পায় ওই যুবক। এর আগে চাচাতো ভাই মোস্তাকুল তালুকদারের সঙ্গে পারিবারিক ঝগড়াকে কেন্দ্র করে প্রাণনাশের অভিযোগ এনে নিজের ক্ষমতার বহিপ্রকাশ ঘটায় চতুর জাহান।

সর্বশেষ, গত ২৫ মার্চ দুপুরে শ্রীপুর বাজারে জুয়াড়ীদের আসরে ধাওয়া করে তাহিরপুর থানা পুলিশ। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি। পুলিশ চলে গেলে সন্দিহান ব্যক্তিদের উপর অভিযোগের আঙুল তুলে জুয়াড়ী ও স্বজনদের কানভারি করে গোষ্ঠিগত সংঘাত বাধার পায়তারা করে জাহান মিয়া ও তার সহযোগী।

জামালপুর গ্রামের ব্যবসায়ী খলিল মিয়া বলেন, গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) দুপুরে সমসার বাঁধ এলাকায় নৌকায় কয়লা আনলোড করার সময়ে পুলিশ-বিজিবি, সাংবাদিক ম্যানেজ করার কথা বলে আবু জাহান ও এম.ডি মুরাদ আমাকে বø্যকমেইল করে ২২ হাজার টাকা নিয়েছে। আমি এখন টাকা ফেরত চাইতে গেলে বিভিন্ন টালবাহানা করছে। বিষয়টি এলাকার সবার মুখে মুখে।

অন্যদিকে অভিযুক্ত মুরাদ মিয়া ইতিপূর্বে নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় গণধোলাইয়ের শিকার হয় চারাগাঁও এলাকায়। এর আগে সীমান্তঘেঁষা চারাগাঁও পাহাড়ী ছড়ায় সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজিকালেও গণধোলাইয়ের শিকার হয় সে। পরে ২০১৬ সালের ১৬ জুন ভূয়া সাংবাদিক মুরাদ মিয়াকে টাঙ্গুয়ার হাওরে দায়িত্বে থাকা তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আটক করেন। পরে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় একমাসের কারাদন্ড প্রদান করেন। জেলের গানি ঠেনে নীরব থাকলেও কয়েকমাস পরেই পুরনোরুপে ফিরে জীবিকা নির্বাহ করছে।

অভিযোগের বাপারে জানতে চাইলে আবু জাহান মিয়া নিজেকে কোন পত্রিকার প্রতিনিধি পরিচয় দেয়নি। তার কাছে কোন বৈধ নিয়োগপত্র কিংবা আইডি কার্ড আছে কিনা সেব্যাপারেও মুখ খুলেনি। জিজ্ঞাস করা হলে এ প্রতিবেদকের পরিচয় পাওয়া মাত্র সংযোগটি কেটে দেয়। অন্যদিকে প্রতারক মুরাদ এ প্রতিবেদকের কল পাওয়ামাত্র সংযোগটি বন্ধ করে দেয়। তবে নিজের ফেইসবুক পেইজে সে নিজেকে দৈনিক সকালের সময় পত্রিকার প্রতিনিধি বলে পরিচয় দেয়।
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন খান বলেন,এর আগেও তারা ফিল্মি স্টাইলে ব্যবসায়ী মল্লিক মিয়ার কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়ের ঘটনায় চাঁদাবাজী মামলার আসামী হয়েছিল। সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ রেস্টহাউসে আমার হাতেপায়ে ধরে চাঁদাবাজীর মামলা থেকে রেহাই পায় এবং আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করে সাংবাদিকতার নামে কাউকে বø্যাকমেইল ও চাঁদাবাজী করবেনা। কিন্তু এই ঘটনার একমাস অতিবাহিত হতেনা হতেই আরেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছে বø্যাকমেইল করে। এরা কি আসলে সাংবাদিক না ডাকাত পুলিশের উচিত এদের ব্যাপারে উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা।
তাহিরপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন,এসব ভূয়া সাংবাদিকের জায়গা তাহিরপুর প্রেসক্লাবে নেই। সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদস্য রাজু আহমদ রমজান বলেন, এসব কারণে এখন সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। চেয়ারম্যান আলী হায়দর বলেন, আবু জাহান ও মুরাদ কর্তৃক ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেইল করে ২২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এলাকার মানুষের মুখে মুখে। আমরা চেষ্টা করছি এই প্রতারকরা যাতে প্রতারিত ব্যবসায়ীর টাকা ফিরিয়ে দেয়। নাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরাও অবস্থান নেবো। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার মো.এহসান শাহ বলেন,বø্যাকমেইলের শিকার ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে অভিযোগ দিলে প্রতারক চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহন করবে পুলিশ।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

সর্বশেষ