বছরের বেশিরভাগ সময়ই আবহাওয়া সহনীয় থাকলেও বিদেশের আদলে দেশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে সরকারি ভবন। পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় ভবনগুলোতে সারা বছর ব্যবহার করা হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র। ফলে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের এসি ব্যবহারের পরিপত্র বাস্তবসম্মত নয়। ফলে যে যার মতো নিচ্ছেন এসির সুবিধা। ভবনগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকার কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করেছেন পরিকল্পনাবিদরা।
গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁও, সেগুনবাগিচা, মতিঝিলসহ আরও কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পরিবেশবান্ধব ভবনের জন্য যে উপাদান থাকা প্রয়োজন সেগুলো নেই। সরকারি ভবনগুলো গড়ে তোলা হয়েছে যেনতেনভাবে। সরকারি অনেক অফিস আগারগাঁওয়ে। এসব অফিসের ভবন স্থাপত্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। তবে বেশিরভাগ ভবন যে যার মতো তৈরি করছে। ফলে একই নকশা ও পরিবেশবান্ধব ভবন তৈরি করা যায়নি। জমির স্বল্পতা ও ভবিষ্যৎ জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে পরিবেশবান্ধব বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য স্থপতিদের প্রতি একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ আধুনিক এই সময়েও বেশিরভাগ অফিস হয়েছে আবদ্ধ ভবনে। বসানো হয়েছে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। কিছু কিছু ভবন হয়েছে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না রেখে। কোথাও নেই সবুজ। নেই ফাঁকা জায়গা, পার্ক কিংবা মাঠ।জানা যায়, রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় কপিরাইট ভবন, জাতীয় রাজস্ব ভবন. পর্যটন ভবন, বিডা ভবন, আইসিটি ভবন, নির্বাচন কমিশন ভবন, জাতীয় সংসদ, বিটিআরসি ভবন, ডাক ভবন, এলজিইডি ভবন, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, জিটিসিএল ভবন, সিপিটিউ ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে খরচ হচ্ছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ। এ এলাকায় এসির ব্যবহার বেশি হওয়ায় আশপাশে তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ভবনের আশপাশে খোলা জায়গা ও সূর্যের আলো থাকা বাঞ্ছনীয়। ভবন পরিবেশবান্ধব করতে পারলে অনেকটাই বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব।
ইউরোপ-আমেরিকার আদলে ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেড়ে নিচ্ছে সরকারি দপ্তরগুলো। অথচ গ্লাসের সঙ্গে লুবার ও জানালা খোলা গেলে বছরের সাত থেকে আট মাস এসি ছাড়াই চলা যাবে। সূর্যের তাপ ভেতরে এলে প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। তবে বিদ্যুৎ ব্যবহার সাশ্রয়ের জন্য সচেতনতা ও সরকারের অনুশাসন প্রয়োজন।
স্থাপত্য অধিদপ্তরকে সরকারি ভবন টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করে নকশা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া আছে। অথচ অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি ও বিদেশি কনসালট্যান্টদের পরামর্শ নিয়ে ভবন করা হচ্ছে। আগারগাঁওয়ে এলজিইডি ও ডাকসহ একাধিক ভবন বেসরকারি ও বিদেশি পরামর্শক কাজ করেছেন। দেশের পরামর্শকরা আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো জানেন, তাই তাদের দিয়ে নকশা প্রণয়ন করলে সুফল পাওয়া যেত।
নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০ বছর আগে আগারগাঁও এলাকা ছিল সবুজে ঘেরা। এখন সেই সবুজ নেই। সংশ্নিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, দেশে অল্প জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হয়। বিদেশ থেকে আনতে হয় নির্মাণসামগ্রী। এসব প্রযুক্তিকে সমন্বয় করে এসি বসানো হয়। তবে দেশের ভবনগুলো আমাদের মতো হওয়া উচিত। এ জন্য ভবনের আশপাশে গাছপালা লাগাতে হবে।
স্থাপত্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান স্থপতি আসিফুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ডিপিপিতে যেভাবে বলা হয়, আমরা সেভাবেই কাজ করি। সেখানে আমাদের বেশি কিছু করার থাকে না। কোনো কিছু পরিবর্তন করলেও সেটা আবার অনুমোদন নেওয়া হয়। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে ইউটিউবের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নকশা দেখে সেভাবেই কাজ করে চায়। এতে স্থপতিদের নিজেদের কিছু করার থাকে না।
এলোমেলো পরিপত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থা :এসি ব্যবহারের প্রাপ্যতা নির্ধারণ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ-সংক্রান্ত পরিপত্র মন্ত্রণালয়, বিভাগ, মাঠ প্রশাসন, অধিদপ্তর, দপ্তর ও পরিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জন্য জারি করা হয়েছে। আবার পদের ক্ষেত্রে শুধু সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী সচিব ও প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের পদ উল্লেখ করা রয়েছে। তবে এসব পদের গ্রেড অনুযায়ী অন্য কর্মকর্তাদের এসি ব্যবস্থা করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এতে মাঠ প্রশাসনের ও দপ্তর-অধিদপ্তরের যে যার মতো এসির সুবিধা নিচ্ছেন। অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। আবার অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেও এসি সুবিধা পাচ্ছেন না। তেজগাঁওয়ের ভূমি রেজিস্ট্রেশন ভবনে রাষ্ট্রীয় অনেক গোপনীয় নথির কাজ হলেও কর্মচারীদের কষ্ট করে গরমে কাজ করতে হয়।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, উচ্চপদস্থ হলে বেশি গরম, আর নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের কম গরম বিষয়টি এমন হওয়া উচিত নয়। গণতান্ত্রিক দেশে এমন নীতি হতে পারে না। বরং কাজের ধরন অনুযায়ী এসি ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজ। কনফারেন্স, মিটিং রুম, গোপনীয় ও অ্যাকাউন্স শাখাসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের এসি থাকতে পারে।