কুষ্টিয়া প্রতিনিধি-
১৬০ বছর আগে অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর জেলা নদীয়ার মহকুমা কুষ্টিয়া অঞ্চলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর শিক্ষা বিস্তারে প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া এইচ ই স্কুল। জুবিলি বিল্ডিংটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেন প্রধান ভুমি দাতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাবা বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রায় সাড়ে ১২ একর জমির উপর গড়ে উঠে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া হাইস্কুল।
ভূমি রেকর্ড বিভাগের সূত্র মতে, সিএস রেকর্ডীয় ৩ টি দাগে ১২ দশমিক ৩৫ একর, এসএ রেকর্ডীয় ৪ টি দাগে ১০ দশমিক ৭৬ একর এবং সর্বশেষ আরএস খতিয়ান ভুক্ত ১৪ টি দাগে ৮ দশমিক ৩ একর জমির ভূমিকর পরিশোধ করে স্বত্ত্ববান স্কুলটি তার বর্তমান অস্তিত্বও ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিদ্যমান ভূ-সম্পত্তি এখন দুই তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে আশপাশের দখলবাজদের আগ্রাসনে।
তৎকালীন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত শিক্ষা কারিকুলামে এই স্কুল থেকে পাঠ গ্রহণ করে কাজী মোতাহার হোসেন, কথা সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল, বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এসআর খানদের মতো অসংখ্য গুণী কৃতি সন্তানেরা নানা ক্ষেত্রে নিজ নিজ কর্মগুণে ঐতিহাসিক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। অথচ এসব এখন কেবলই অতীত। বিস্তীর্ণ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটি এখন দখলবাজদের খপ্পরে চরমভাবে অস্তিত্ব সংকটে। এমন বিপন্নের হাত থেকে প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করে তার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফেরানোর দাবি জেলার সচেতন মহলের।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে কুষ্টিয়ায় প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুল জলিল বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলিতে প্রতিদিনের আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো এই কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠটি। এখানেই বঙ্গবন্ধু এসে ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষণ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছিলেন। অথচ সেই মাঠটি এখন দেখলে কান্না আসে। প্রয়োজনে সরকারের নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগ করে হলেও প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করার দাবি করছি।
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, এক সময়ের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর মানুষ গড়ার কারখানা নেই। সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন প্রভাবশালী মহলের ব্যবসায়িক ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। দখলবাজদের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চরম অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
১৯৯৯ সালে সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বাচ্চু জোড়পূর্বক দুইটি ঘরের জায়গা লিখে নেন প্রধান শিক্ষক লুলু উল বাহারের কাছ থেকে। ২০০১ সালে চেয়ারম্যান ইসরাইল হোসেন আফু পৌরসভার জায়গা দাবি করে স্কুল মাঠের পূর্বপাশে এনএস রোড থেকে রেললাইন পর্যন্ত দোকান ঘর তৈরি করেন। যার বিরুদ্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষকে মামলা করতে হয়েছিলো। পরে আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সম্পত্তিটি স্কুলের বলে আদেশ হওয়ায় পৌর কর্তৃপক্ষ ওই জমিটি ছেড়ে দেয়।
এখানকার দোকান মালিক সাইফুল ইসলাম, মুরাদ চৌধুরী, মিতালী মাইকের মালিকসহ ২০/২৫ জন মিলে দল পাকিয়েছেন। তারা বেশ কিছুসংখ্যক ভুয়া ষ্ট্যাম্প তৈরি করে প্রধান শিক্ষক লুলু উল বাহারের উপর চাপ সৃস্টি করে ভাড়ার চুক্তির খাজনা রশিদ কাটতে বাধ্য করেন।
এসময় তাদের স্ট্যাম্পগুলো সঠিক কিনা, তা নিরীক্ষা করতে স্কুলের ফাইল খুঁজে দেখা যায়, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খোয়া গেছে এবং উইপোকা নষ্ট করে দিয়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে দোকান মালিকরা শুধুমাত্র খাজনা রশিদ দাখিল করে আদালতে কোর্ট রেন্ট মামলা করে স্কুল কর্তৃপক্ষকে থামিয়ে দেন।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে মিতালী মাইকের মালিক আনোয়ার আলী বলেন, স্কুলের জায়গা ব্যবহারে সবাই অনিয়ম করছেন, আমিও করছি। তবে আমি দোকানের পেছনে আবাসিক ভবন করতে যতটুকু বেশি জায়গা ব্যবহার করছি সেটা খুব শিগগিরই ছেড়ে দেব।
জানা যায়, ২০০৯ থেকে ১১ পর্যন্ত বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদে সভাপতির দায়িত্বে আসেন চৌধুরী মুর্শেদ আলাম মধু। এই সময়টাতে কিছু অনিয়মের সুযোগ পেয়ে এসব দোকান মালিক সমিতির লোকজন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তারা অধিকাংশই একটার কথা বলে একাধিক দোকান ঘর দখলে নেয়। এই সময়কালে স্কুলের ভূসম্পত্তির চৌহদ্দির পূর্ব পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের জমি দখলের উৎসব চলে।
এই দখল উৎসব রোধে নেওয়া নানা উদ্যোগকে ভেস্তে দেয় দোকান মালিকরা বলে দাবি করেন চৌধুরী মুর্শেদ আলাম মধু।
বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ডা: এ কে এম মুনীর বলেন, নানা কারণে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে চৌহদ্দি সীমানা রক্ষার স্বার্থে অবকাঠামো নির্মাণসহ আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করতে দোকানঘর তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এসব দোকানঘর নানাভাবে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কুক্ষিগত করেছেন। ব্যাপারটা এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, গরীবের বউ সকলে ভাবী; যে যখন সুযোগ পেয়েছে ইচ্ছামতো ধর্ষণ করেছে। এসব কিছু দেখে চোখের জল ফেলা ছাড়া স্কুলের শিক্ষকদের কিছুই করার ছিলো না। মুখ খুল্লেই মামলার খড়গ। তাই স্কুলের সম্পত্তি রক্ষায় শিক্ষকরা কেউই প্রতিবাদ করার সাহস দেখান নি।
তিনি বলেন, স্কুল মাঠের পূর্বদিক থেকে শুরু করে পশ্চিম দিক পর্যন্ত ৫০ টির বেশি দোকান মালিক বিদ্যালয় তহবিলে কোন টাকা দেয়নি। এছাড়া পশ্চিম পাশের সীমানায় এন এস রোড থেকে রেল লাইন পর্যন্ত ১০ফিট চওড়া ধরে সম্পূর্ণ জায়গাটি দখলে নিয়েছেন পাশের প্রতিবেশীরা। এছাড়া যারা ঘরভাড়ার চুক্তি করেছেন তারা অনেকেই সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ না করায় প্রায় ৫০ লাখ টাকার বেশি অনাদায়ী রয়েছে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান বলেন, এদিকে দেড়শ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত পুরনো ভবনের সবগুলো কক্ষের ছাদ খসে পড়ছে।