আমিনুল হক, সুনামগঞ্জ
‘ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে অনিয়ম হলে ছাড় নেই’ বলেলন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী । হাওর পরিদর্শন কালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, প্রথম শ্রেণির ২২ জন ঠিকাদারকে তাদের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য আমরা কালো তালিকাভুক্ত করেছি। হাওরের বাঁধের কাজে অনিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার (০৭ এপ্রিল) সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে হাওরে যেহেতু ফসল ডুবে গেছে সেজন্য আমরা রোববার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে উচ্চ পর্যায়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবো। সেই কমিটি সুনামগঞ্জে এসে সুষ্ঠু তদন্ত করবে। সেই তদন্ত অনুযায়ী হাওরের বাঁধের কাজে যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা কিংবা পিআইসির কেউ অনিয়মে জড়িত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম।
এদিকে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই ঢলে সুনামগঞ্জের কয়েকটি হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছে নাগরিক সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’। তাদের দাবি, যথাযথভাবে বাঁধের কাজ না হওয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে আরও প্রায় ৩০ হাওরের ফসল।
২০০৭ সালের অকালবন্যায় হাওরের ব্যাপক ফসলহানির পর ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ নামের এই নাগরিক সংগঠনটি গড়ে ওঠে। এ বছরও অকালবন্যায় বাঁধ ভেঙে কয়েকটি হাওরে পানি প্রবেশ করেছে। তলিয়ে গেছে টাঙ্গুয়াসহ একাধিক হাওরের শতাধিক হেক্টর ফসল। ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে গাফিলতি ও অনিয়মের কারণেই হাওরে পানি ঢুকে ফসল তলিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বুধবার ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’-এর সংবাদ সম্মেলনেও একই অভিযোগ করা হয় বলে জানান নেতৃবৃন্দ। অলিউর রহমান চৌধুরী বকুল বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় গত ২ এপ্রিল বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর। ৪ এপ্রিল শাল্লা, ছাতক ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি হাওর এবং সর্বশেষ ৫ এপ্রিল বিকেলে ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থালহাওর তলিয়ে যায়। এতে তলিয়ে গেছে এসব হাওরের বোরো ধান। ‘কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো বাঁধের কাজই শতভাগ শেষ হয়নি। শতকোটি টাকার প্রকল্পে শুরু থেকেই কোনো মনিটর করা হয়নি।’অলিউর রহমান চৌধুরী বকুল বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় জেলার মাটিয়ান হাওর, শনির হাওর, দেখার হাওর, জামখলা হাওর, কাঁচিভাঙ্গা হাওর, সাংহাই হাওর, খাই হাওর, নান্দাইর হাওর, মাচুখালী হাওর, চাওলির হাওর, খরচার হাওর, আঙ্গুর আলীর হাওর, পুটিয়ার হাওর, হালির হাওরসহ ৩০টির বেশি হাওরে ফসল আজ হুমকির মুখে। এসব হাওরে বাঁধের কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এখনও বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। ফলে বাঁধ ভেঙে যেকোনো সময় ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।’ বকুল আরো বলেন, ‘গত ৩ এপ্রিল রাত থেকে এসব হাওরের কৃষকরা বাঁধের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ফসল রক্ষায় দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, সুনামগঞ্জের হাওরে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে। এ বছর জেলায় বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ লাখ টন। হাওর-অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের একমাত্র ফসল বোরো ধান। কারণ এ জেলার ছোট-বড় ৯২টি হাওর বছরের বেশির ভাগ সময়ই পানির নিচে থাকে। শুধু এই সময়ে বোরো চাষ করা হয়। তবে বৃষ্টি ও ঢলে নদীর পানি উপচে যাতে হাওরে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য প্রতি বছরই নির্মাণ করা হয় হাওররক্ষা বাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এ বছর ১২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৪১টির বেশি হাওরে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৪ কোটি টাকা। প্রতিটি পিআইসিতেই সভাপতি হিসেবে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা। এই দুই কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেই বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা অলিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘কাজের শুরু থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন উপজেলায় পিআইসি গঠনে নয়ছয় করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দেয়া হয়েছে।’ অভিযুক্ত পিআইসি সদস্যরা গা-ঢাকা দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি। তবে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘বাঁধের কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সে জন্য আমরা কঠোরভাবে নজরদারি করেছি। তবু কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।’ কিছু বাঁধ উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা ফসল রক্ষায় দিন-রাত পরিশ্রম করে করে যাচ্ছি। স্থানীয় কৃষকরাও সহযোগিতা করছেন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের হাত নেই।’